বাংলা গদ্যাংশের প্রতিটি গদ্য নিখুত ভাবে আয়ত্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় গদ্যাংশ থেকে অনেক প্রশ্ন থাকে এবং তা হুবহু কমন পড়ে। আমাদের এ আয়োজনে প্রশ্নোত্তরগুলো পড়লে ১০০% কমন পাবে ইনশাআল্লাহ।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ১০০% প্রস্তুতির জন্য এই ব্লগের সাথে থাকুন ও “উষা বাংলা প্রশ্নব্যাংক ও সাজেশন্স” পড়ুন। সাথে আমাদের অনলাইন/অফলাইন কোচিং এ ক্লাস/ক্লাস টেস্ট/মডেল পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে আরও উপযোগী করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি সফল হবেন। যোগাযোগ: 01736960513 https://usawuac.com
প্রতিটি গল্প/প্রবন্ধ/পদ্য এর ক্লাস/ক্লাস টেস্ট মডেল টেস্ট পরীক্ষা দিতে যোগাযোগ করুন- 01736960513 [সকল বিষয়ে অনলাইন/অফলাইন]
বাংলা গদ্য অংশের সিলেবাসভুক্ত গল্প/প্রবন্ধ
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন
১. যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে
না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে।
২. টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন
অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়; লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের
এখনও সেদিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোক-রঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল
হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া
লোক-রঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে।
৩. যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা
মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে
অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ
ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।
৪. যাহা অসত্য, ধর্মবিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা পরপীড়ন
বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকল প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না, সুতরাং
তাহা একেবারে পরিহার্য্য। সত্য ও ধর্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে
লেখনী-ধারণ মহাপাপ।
৫. যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছু
কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছুকাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে
অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তার পর সংশোধন
করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্যে ব্রতী, তাঁহাদের
পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না। এজন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর।
৬. যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই, সে বিষয়ে তাহার
হস্তক্ষেপ অকর্ত্তব্য। এটি সোজা কথা, কিন্তু সাময়িক সাহিত্যকে এ নিয়মটি রক্ষিত হয়
না।
৭. বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা
থাকিলে, তাহা আপনিই প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা
পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর, এবং রচনার পারিপাট্যের বিশেষ হানিজনক। এখনকার প্রবন্ধে
ইংরেজি, সংস্কৃত, ফরাশি, জর্ম্মান কোটেশন বড় বেশী দেখিতে পাই। যে ভাষা আপনি
জানেন না, পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধৃত করিবেন না।
৮. অলঙ্কার-প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত
হইবেন না। স্থানে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে; লেখকের ভাণ্ডারে এ
সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজন মতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে—ভাণ্ডারে না থাকিলে
মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভাণ্ডারে অলঙ্কার প্রয়োগের বা রসিকতার
চেষ্টার মত কদর্য্য আর কিছুই নাই।
৯. যে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া
বোধ হইবে, সেই স্থানটি কাটিয়া দিবে, এটি প্রাচীন বিধি। আমি সে কথা বলি না। কিন্তু
আমার পরামর্শ এই যে সে স্থানটি বন্ধুবর্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে। যদি ভালো
না হইয়া থাকে, তবে দুই চারি বার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভালো লাগিবে না—বন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে। তখন উহা কাটিয়া দিবে।
১০. সকল অলঙ্কারের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার সরলতা। যিনি
সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজেই পাঠককে বুঝাইতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। কেন
না, লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝান।
১১. কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত
হয়, গুণগুলি হয় না, অমুক ইংরেজি বা সংস্কৃত বা বাঙ্গালা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন,
আমিও এরূপ লিখিব, এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না।
১২. যে কথার প্রমাণ দিতে পারিবে না, তাহা লিখিও না।
প্রমাণগুলি প্রযুক্ত করা সকল সময়ে প্রয়োজন হয় না, কিন্তু হাতে থাকা চাই।
১৩. বাঙ্গালা সাহিত্য, বাঙ্গালার ভরসা। এই নিয়মগুলো
বাঙ্গালা লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে, বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে
থাকিবে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর:
০১. লেখকের ‘লোকরঞ্জন-প্রবৃত্তি’ প্রবল হয়ে ওঠে কী কারণে?
উত্তর: অর্থলাভের আশায় শিখলে।
০২. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘লেখা’ বিলম্বে ছাপাতে বলেছেন কেন?
উত্তর: লেখার ভুল-ক্রটি সংশোধন করতে।
০৩. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোন শতকের শ্রেষ্ঠ লেখ হিসেবে পরিচিত?
উত্তর: উনিশ শতকের ।
০৪. ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়?
উত্তর: প্রচার পত্রিকায় ১৮৮৫ সালে।
০৫. প্রবন্ধটি কোন গ্রন্থের অন্তভুক্ত ছিল?
উত্তর: বিবিধ প্রবন্ধ গ্রন্থের ।
০৬. ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ প্রবন্ধটি কোন রীতিতে লেখা?
উত্তর: সাধু রীতিতে।
০৭. অংলকার শব্দের অর্থ কি?
উত্তর: ভূষণ, প্রসাধন, শোভা। ভাষার মাধুর্য ও উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে এমন গুণ।
০৮. সকল অলংকারের শ্রেষ্ঠ অলংকার কি?
উত্তর: সরলতা।
০৯. কোন নিয়মগুলি বাঙ্গালার লেখদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে, বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে?
উত্তর: বাঙ্গালা সাহিত্য ও বাঙ্গালার ভরসা।
১০. ‘বাঙ্গালা’ শব্দটির পরিবর্তন হয়েছে কি ভাবে?
উত্তর: বাঙ্গালা-বাঙলা-বাংলা।
অপরিচিতা
লেখক
পরিচিতিঃ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে বাংলা ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ এ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ
করেন। তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদা দেবী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোট গল্প রচয়িতা এবং বাংলা ছোটগল্পের শেষ্ঠ
শিল্পী। তাঁর লেখনীতেই বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব, বিকাশ এবং সমৃদ্ধি ঘটেছে। তাঁর ছোটগল্প
বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলো সমতুল্য। ১২৮৪ বঙ্গাব্দে মাত্র ষোল বছর বয়সে “ভিখারিনী” গল্প রচনার
মাধ্যমে ছোটগল্প লেখক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর থেকে জীবনের প্রায় শেষ দিন
পর্যন্ত দীর্ঘ চৌষট্টি বছরে তিনি অখন্ড ‘গল্পগুচ্ছ’ সংকলিত ৯৫টি
ছোটগল্প রচনা করেছেন। এর বাইরেও ‘সে’, ‘অল্পসল্প’ এবং ‘লিপিকা’ গ্রন্থে
রয়েছে তাঁর আরও গল্প সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত সর্বশেষ গল্পটির নাম
হলো ‘মুসলমানীর গল্প।
পারিবারিক
জমিদারি তদারকির সূত্রে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বসবাসের কালই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প
রচনার স্বর্ণযুগ। ‘সোনারতরি’ কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলাও তিনি একই
সময়ে রচনা করেন। প্রকৃতির পটে জীবনকে
স্থাপন করে জীবনের গীতময় বিশ্বজনীন প্রকাশই রবীন্দ্রগল্পের শেষ্ঠ সম্পদ। তবে বিশ
শতকে রচিত গল্পে প্রকৃতি ও গীতময়তার স্থলে বাস্তবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। গল্পকার
হিসেবে তিনি যেমন বরেণ্য; ঔপন্যাসিক হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান সুনির্দিষ্ট।
তাঁর রচিত উপন্যাস গুলোর মধ্যে ‘চোখের বালি’, ‘গোরা’,
‘চতুরঙ্গ’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘শেষের কবিতা’, ‘যোগাযোগ’, বাংলা উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। নাটক
রচনার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের শেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত। তাঁর রচিত বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো: ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’, ‘ডাকঘর’, ‘মুক্তধারা’ ‘রক্তকরবী’।
১৯৪১
খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট বাংলা ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২এ শ্রাবণ
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবড়িতে রবীন্দ্রনাথের জীবনাসা ঘটে।

আজ আমার বয়স
সাতাশ মাত্র। এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যরে হিসাবে বড়, না গুণের হিসাবে।
তবু ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে। ইহা সেই ফুলের মতো যাহার বুকের উপরে ভ্রমর আসিয়া
বসিয়াছিল, এবং
সেই পদক্ষেপের ইতিহাস তাহার জীবনের মাঝখানে ফলের মতো গুটি ধরিয়া উঠিয়াছে। সেই
ইতিহাসটুকু আকারে ছোটো, তাহাকে ছোটো করিয়াই লিখিব। ছোটোকে যাঁহারা সামান্য বলিয়া
ভুল করেন না তাঁহারা ইহার রস বুঝিবেন।
কলেজে
যতগুলো পরীক্ষা পাস করিবার সব আমি চুকাইয়াছি। ছেলেবেলায় আমার সুন্দর চেহারা লইয়া পণ্ডিতমশায় আমাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সহিত
তুলনা করিয়া,
বিদ্রূপ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। ইহাতে তখন বড়ো লজ্জা পাইতাম; কিন্তু বয়স
হইয়া এ কথা ভাবিয়াছি,
যদি জন্মান্তর থাকে তবে আমার মুখে সুরূপ এবং পণ্ডিতমশায়দের
মুখে বিদ্রূপ আবার যেন অমনি করিয়াই প্রকাশ পায়।
আমার পিতা
এক কালে গরিব ছিলেন। ওকালতি করিয়া তিনি প্রচুর
টাকা রোজগার করিয়াছেন,
ভোগ করিবার সময় নিমেষমাত্রও পান নাই। মৃত্যুতে তিনি
যে হাঁফ ছাড়িলেন সেই তাঁর প্রথম অবকাশ।
আমার তখন
বয়স অল্প। মার হাতেই আমি মানুষ। মা গরিবের ঘরের মেয়ে; তাই, আমরা যে ধনী
এ কথা তিনিও ভোলেন না,
আমাকে ভুলিতে দেন না। শিশুকালে আমি কোলে কোলেই মানুষ’বোধ করি, সেইজন্য শেষ
পর্যন্ত আমার পুরাপুরি বয়সই হইল না। আজও আমাকে দেখিলে মনে হইবে, আমি অন্নপূর্ণার
কোলে গজাননের ছোটো ভাইটি।
আমার আসল
অভিভাবক আমার মামা। তিনি আমার চেয়ে বড়োজোর বছর ছয়েক বড়। কিন্তু ফল্গুর বালির
মতো তিনি আমাদের সমস্ত সংসারটাকে নিজের অন্তরের মধ্যে শুষিয়া লইয়াছেন। তাঁহাকে না
খুঁড়িয়া এখানকার এক গণ্ডুষও রস পাইবার জো নাই। এই কারণে
কোনো-কিছুর জন্যই আমাকে কোনো ভাবনা ভাবিতেই হয় না।
কন্যার পিতা
মাত্রেই স্বীকার করিবেন, আমি সৎপাত্র। তামাকটুকু পর্যন্ত খাই না। ভালোমানুষ হওয়ার
কোনো ঝঞ্ঝাট নাই, তাই
আমি নিতান্ত ভালোমানুষ। মাতার আদেশ মানিয়া চলিবার ক্ষমতা আমার আছে’ বস্তুত, না মানিবার
ক্ষমতা আমার নাই। অন্তঃপুরের শাসনে চলিবার মতো করিয়াই আমি প্রস্তুত হইয়াছি, যদি কোনো
কন্যা স্বয়ম্বরা হন তবে এই সুলক্ষণটি স্মরণ রাখিবেন।
অনেক বড়ো ঘর
হইতে আমার সম্বন্ধ আসিয়াছিল। কিন্তু মামা, যিনি পৃথিবীতে আমার ভাগ্যদেবতার প্রধান এজেন্ট, বিবাহ
সম্বন্ধে তাঁর একটা বিশেষ মত ছিল। ধনীর কন্যা তাঁর পছন্দ নয়। আমাদের ঘরে যে মেয়ে
আসিবে সে মাথা হেঁট করিয়া আসিবে, এই তিনি চান। অথচ টাকার প্রতি আসক্তি তাঁর
অস্থিমজ্জায় জড়িত। তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা
নাই অথচ যে টাকা দিতে কসুর করিবে না। যাহোক শোষণ করা চলিবে অথচ বাড়িতে আসিলে
গুড়গুড়ির পরিবর্তে বাঁধা হুঁকায় তামাক দিলে যাহার নালিশ খাটিবে না।
আমার বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ
করে। সে ছুটিতে কলিকাতায় আসিয়া আমার মন উতলা করিয়া দিল। সে বলিল, “ওহে, মেয়ে
যদি বল একটি খাসা মেয়ে আছে।”
কিছুদিন
পূর্বেই এমএ পাস করিয়াছি। সামনে যত দূর পর্যন্ত
দৃষ্টি চলে ছুটি ধূ ধূ করিতেছে; পরীক্ষা নাই, উমেদরি নাই, চাকরি নাই; নিজের বিষয়
দেখিবার চিন্তাও নাই,
শিক্ষাও নাই, ইচ্ছাও
নাই’ থাকিবার
মধ্যেও ভিতরে আছেন মা এবং বাহিরে আছেন মামা।
এই অবকাশের
মরুভূমির মধ্যে আমার হৃদয় তখন বিশ্বব্যাপী নারীরূপের মরীচিকা দেখিতেছিল’আকাশে তাহার
দৃষ্টি, বাতাসে
তাহার নিঃশ্বাস, তরুমর্মরে
তাহার গোপন কথা। এমন সময় হরিশ আসিয়া বলিল, “মেয়ে যদি বল, তবে”। আমার
শরীর-মন বসন্তবাতাসে বকুলবনের নবপল্লবরাশির মতো
কাঁপিতে কাঁপিতে আলোছায়া বুনিতে লাগিল। হরিশ মানুষটা ছিল রসিক, রস দিয়া
বর্ণনা করিবার শক্তি তাহার ছিল, আর আমার মন ছিল তৃষার্ত।
আমি হরিশকে
বলিলাম, “একবার
মামার কাছে কথাটা পাড়িয়া দেখো।”
হরিশ আসর
জমাইতে অদ্বিতীয়। তাই সর্বত্রই তাহার খাতির। মামাও
তাহাকে পাইলে ছাড়িতে চান না। কথাটা তাঁর বৈঠকে উঠিল। মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের
খবরটাই তাঁহার কাছে গুরুতর। বাপের অবস্থা তিনি যেমনটি চান তেমনি। এক কালে ইহাদের
বংশে লক্ষ্মীর মঙ্গলঘট ভরা ছিল। এখন তাহা শূন্য
বলিলেই হয়, অথচ
তলায় সামান্য কিছু বাকি আছে। দেশে বংশমর্যাদা রাখিয়া চলা সহজ নয় বলিয়া ইনি পশ্চিমে
গিয়া বাস করিতেছেন। সেখানে গরিব গৃহস্থের মতোই থাকেন। একটি মেয়ে ছাড়া তাঁর আর নাই।
সুতরাং তাহারই পশ্চাতে লক্ষ্মীর ঘটটি একেবারে উপুড় করিয়া দিতে দ্বিধা
হইবে না।
এসব ভালো
কথা। কিন্তু, মেয়ের
বয়স যে পনেরো, তাই শুনিয়া মামার মন ভার হইল। বংশে তো
কোনো দোষ নাই? না, দোষ নাই’ বাপ কোথাও
তাঁর মেয়ের যোগ্য বর খুঁজিয়া পান না। একে তো বরের হাট মহার্ঘ, তাহার পরে
ধনুক-ভাঙা পণ, কাজেই
বাপ কেবলই সবুর করিতেছেন’ কিন্তু মেয়ের বয়স সবুর করিতেছে না।
যাই হোক, হরিশের সরস
রসনার গুণ আছে। মামার মন নরম হইল। বিবাহের ভূমিকা-অংশটা নির্বিঘেড়ব সমাধা হইয়া
গেল। কলিকাতার বাহিরে বাকি যে পৃথিবীটা আছে সমস্তটাকেই মামা আন্ডামান দ্বীপের অন্তর্গত বলিয়া জানেন। জীবনে একবার
বিশেষ কাজে তিনি কোনড়বগর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মামা যদি মনু হইতেন তবে তিনি হাবড়ার
পুল পার হওয়াটাকে তাঁহার সংহিতায় একেবারে নিষেধ করিয়া দিতেন। মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল, নিজের চোখে
মেয়ে দেখিয়া আসিব। সাহস করিয়া প্রস্তাব করিতে পারিলাম না।
কন্যাকে
আশীর্বাদ করিবার জন্য যাহাকে পাঠানো হইল সে আমাদের বিনুদাদা, আমার পিসতুতো ভাই। তাহার মতো রুচি এবং দক্ষতার ’পরে আমি ষোলো-আনা
নির্ভর করিতে পারি। বিনুদা ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “মন্দ নয় হে! খাঁটি সোনা বটে!” বিনুদাদার ভাষাটা অত্যন্ত আঁট। যেখানে
আমরা বলি ‘চমৎকার’ সেখানে তিনি
বলেন ‘চলনসই’।
অতএব বুঝিলাম, আমার
ভাগ্যে প্রজাপতির সঙ্গে পঞ্চশরের কোনো বিরোধ নাই।

বলা বাহুল্য, বিবাহ-উপলক্ষে
কন্যাপক্ষকেই কলিকাতায় আসিতে হইল। কন্যার পিতা শম্ভুনাথবাবু হরিশকে কত বিশ্বাস
করেন তাহার প্রমাণ এই যে, বিবাহের তিন দিন পূর্বে তিনি আমাকে প্রথম চক্ষে দেখেন এবং
আশীর্বাদ করিয়া যান। বয়স তাঁর চল্লিশের কিছু এপারে
বা ওপারে। চুল কাঁচা,
গোঁফে পাক ধরিতে আরম্ভ করিয়াছে মাত্র। সুপুরুষ বটে। ভিড়ের মধ্যে দেখিলে সকলের
আগে তাঁর উপরে চোখ পড়িবার মতো চেহারা। আশা করি আমাকে দেখিয়া তিনি খুশি হইয়াছিলেন।
বোঝা শক্ত, কেননা
তিনি বড়ই চুপচাপ। যে দুটি-একটি কথা
বলেন যেন
তাহাতে পুরা জোর দিয়া বলেন না। মামার মুখ তখন অনর্গল ছুটিতেছিল’ ধনে মানে
আমাদের স্থান যে শহরের কারও চেয়ে কম নয়, সেইটেকেই তিনি নানা প্রসঙ্গে প্রচার
করিতেছিলেন। শম্ভুনাথবাবু এ কথায় একেবারে যোগই
দিলেন না’ কোনো
ফাঁকে একটা হুঁ বা হ্যাঁ কিছুই শোনা গেল না। আমি হইলে দমিয়া যাইতাম, কিন্তু
মামাকে দমানো শক্ত। তিনি শম্ভুনাথবাবুর চুপচাপ ভাব দেখিয়া ভাবিলেন, লোকটা
নিতান্ত নির্জীব, একেবারে
কোনো তেজ
নাই।
বেহাই-সম্প্রদায়ের আর যাই থাক, তেজ থাকাটা দোষের, অতএব মামা মনে মনে খুশি হইলেন।
শম্ভুনাথবাবু যখন উঠিলেন তখন মামা সংক্ষেপে উপর হইতেই তাঁকে বিদায় করিলেন, গাড়িতে
তুলিয়া দিতে গেলেন না।
পণ সম্বন্ধে
দুই পক্ষে পাকাপাকি কথা ঠিক হইয়া গিয়াছিল। মামা নিজেকে অসামান্য চতুর বলিয়াই
অভিমান করিয়া থাকেন। কথাবার্তায় কোথাও তিনি কিছু ফাঁক রাখেন নাই। টাকার অঙ্ক তো
স্থির ছিলই, তারপরে
গহনা
কত ভরির এবং
সোনা কত দরের হইবে সেও একেবারে বাঁধাবাঁধি হইয়া গিয়াছিল।
আমি নিজে
এসমস্ত কথার মধ্যে ছিলাম না; জানিতাম না দেনা-পাওনা কী স্থির হইল। মনে জানিতাম, এই স্থূল
অংশটাও বিবাহের একটা প্রধান অংশ, এবং সে অংশের ভার যার উপরে তিনি এক
কড়াও ঠকিবেন না। বস্তুত, আশ্চর্য পাকা লোক বলিয়া মামা আমাদের সমস্ত সংসারের প্রধান
গর্বের সামগ্রী। যেখানে আমাদের কোনো সম্বন্ধ আছে সেখানে সর্বত্রই তিনি বুদ্ধির
লড়াইয়ে জিতিবেন, এ
একেবারে ধরা কথা, এই
জন্য আমাদের অভাব না থাকিলেও এবং অন্য পক্ষের অভাব কঠিন হইলেও জিতিব, আমাদের
সংসারের এই জেদ’ইহাতে
যে বাঁচুক আর যে মরুক।
গায়ে-হলুদ
অসম্ভব রকম ধুম করিয়া গেল। বাহক এত গেল যে তাহার আদম-শুমারি
করিতে হইলে কেরানি রাখিতে হয়। তাহাদিগকে বিদায় করিতে অপর পক্ষকে যে নাকাল হইতে
হইবে, সেই
কথা স্মরণ করিয়া মামার সঙ্গে মা একযোগে বিস্তর হাসিলেন। ব্যান্ড, বাঁশি,
শখের কন্সর্ট প্রভৃতি যেখানে যতপ্রকার উচ্চ শব্দ
আছে সমস্ত একসঙ্গে মিশাইয়া বর্বর কোলাহলের মত্ত হস্তী দ্বারা সংগীত সরস্বতীর পদ্মবন দলিত বিদলিত করিয়া আমি তো বিবাহ-বাড়িতে
গিয়া উঠিলাম।
আংটিতে
হারেতে জরি-জহরাতে আমার শরীর যেন গহনার দোকান নিলামে চড়িয়াছে বলিয়া বোধ হইল।
তাঁহাদের ভাবী জামাইয়ের মূল্য কত সেটা যেন কতক পরিমাণে সর্বাঙ্গে স্পষ্ট করিয়া
লিখিয়া ভাবী শ্বশুরের সঙ্গে মোকাবিলা করিতে
চলিয়াছিলাম।
মামা
বিবাহ-বাড়িতে ঢুকিয়া খুশি হইলেন না। একে তো উঠানটাতে বরযাত্রীদের জায়গা সংকুলান
হওয়াই শক্ত, তাহার
পরে সমস্ত আয়োজন নিতান্ত মধ্যম রকমের। ইহার পরে শম্ভুনাথবাবুর ব্যবহারটাও নেহাত ঠাণ্ডা। তাঁর বিনয়টা অজস্রর নয়। মুখে তো কথাই নাই কোমরে
চাদর বাঁধা, গলা
ভাঙা, টাক-পড়া, মিশ-কালো
এবং বিপুল-শরীর তাঁর একটি উকিল-বন্ধু যদি নিয়ত হাত জোড় করিয়া মাথা হেলাইয়া, নম্রতার
স্মিতহাস্যে ও গদগদ বচনে কন্সর্ট পাটির করতাল-বাজিয়ে হইতে শুরু করিয়া বরকর্তাদের
প্রত্যেককে বার বার প্রচুররূপে অভিষিক্ত
করিয়া না
দিতেন তবে গোড়াতেই এটা এস্পার-ওস্পার হইত।
আমি সভায়
বসিবার কিছুক্ষণ পরেই মামা শম্ভুনাথবাবুকে পাশের ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। কী কথা
হইল জানি না, কিছুক্ষণ
পরেই শম্ভুনাথবাবু আমাকে আসিয়া বলিলেন, “বাবাজি, একবার এই দিকে আসতে হচ্ছে।”
ব্যাপারখানা
এই। ‘সকলের
না হউক, কিন্তু
কোনো কোনো মানুষের জীবনের একটা কিছু লক্ষ্য থাকে। মামার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তিনি
কোনোমতেই কারও কাছে ঠকিবেন না। তাঁর ভয় তাঁর বেহাই তাঁকে গহনায় ফাঁকি দিতে পারেন’বিবাহকার্য
শেষ হইয়া গেলে সে ফাঁকির আর প্রতিকার চলিবে না। বাড়িভাড়া সওগাদ লোক’বিদায়
প্রভৃতি সম্বন্ধে যেরকম টানাটানির পরিচয় পাওয়া গেছে তাহাতে মামা ঠিক করিয়াছিলেন-
দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে এ লোকটির শুধু মুখের কথার উপর ভর করা চলিবে না। সেইজন্য
বাড়ির সেকরাকে সুদ্ধ সঙ্গে
আনিয়াছিলেন। পাশের ঘরে গিয়া দেখিলাম, মামা এক তক্তপোশে এবং সেকরা তাহার দাঁড়িপাল্লা
কষ্টিপাথর প্রভৃতি লইয়া মেজেয় বসিয়া আছে।
শম্ভুনাথবাবু
আমাকে বলিলেন, “তোমার
মামা বলিতেছেন বিবাহের কাজ শুরু হইবার আগেই তিনি কনের সমস্ত গহনা যাচাই করিয়া
দেখিবেন, ইহাতে
তুমি কী বল।”
আমি মাথা
হেঁট করিয়া চুপ করিয়া রহিলাম।
মামা বলিলেন, “ও আবার কী
বলিবে। আমি যা বলিব তাই হইবে।”
শম্ভুনাথবাবু
আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “সেই কথা তবে ঠিক? উনি যা বলিবেন তাই হইবে? এ সম্বন্ধে
তোমার কিছুই বলিবার নাই?”
আমি একটু
ঘাড়-নাড়ার ইঙ্গিতে জানাইলাম, এসব কথায় আমার সম্পূর্ণ অনধিকার। “আচ্ছা তবে
বোসো, মেয়ের
গা হইতে সমস্ত গহনা খুলিয়া আনিতেছি।” এই বলিয়া তিনি উঠিলেন।
মামা বলিলেন, “অনুপম এখানে
কী করিবে। ও সভায় গিয়া বসুক।”
শম্ভুনাথ
বলিলেন, “না, সভায় নয়, এখানেই
বসিতে হইবে।”
কিছুক্ষণ
পরে তিনি একখানা গামছায় বাঁধা গহনা আনিয়া তক্তপোশের উপর মেলিয়া ধরিলেন। সমস্তই
তাঁহার পিতামহীদের আমলের গহনা’ হাল ফ্যাশনের সূক্ষ্ম কাজ নয়’ যেমন মোটা তেমনি ভারী।
সেকরা গহনা
হাতে তুলিয়া লইয়া বলিল, “এ আর দেখিব কী। ইহাতে খাদ নাই’এমন সোনা
এখনকার দিনে ব্যবহারই হয় না।”
এই বলিয়া সে
মকরমুখা মোটা একখানা বালায় একটু চাপ দিয়া দেখাইল তাহা বাঁকিয়া যায়। মামা তখনই
নোটবইয়ে গহনাগুলির ফর্দ টুকিয়া লইলেন, পাছে যাহা দেখানো হইল তাহার কোনোটা কম
পড়ে। হিসাব করিয়া দেখিলেন, গহনা যে পরিমাণ দিবার কথা এগুলি সংখ্যায়, দরে এবং
ভারে তার অনেক বেশি।
গহনাগুলির
মধ্যে একজোড়া এয়ারিং ছিল। শম্ভুনাথ সেইটে সেকরার
হাতে দিয়া বলিলেন, “এইটে
একবার পরখ করিয়া দেখো।”
সেকরা কহিল, “ইহা বিলাতি
মাল, ইহাতে
সোনার ভাগ সামান্যই আছে।”
শম্ভুবাবু
এয়ারিং জোড়া মামার হাতে দিয়া বলিলেন, “এটা আপনারাই
রাখিয়া দিন।”
মামা সেটা
হাতে লইয়া দেখিলেন, এই
এয়ারিং দিয়াই কন্যাকে তাঁহারা আশীর্বাদ করিয়াছিলেন। মামার মুখ লাল হইয়া উঠিল।
দরিদ্র তাঁহাকে ঠকাইতে চাহিবে কিন্তু তিনি ঠকিবেন
না এই আনন্দ-সম্ভোগ হইতে বঞ্চিত হইলেন এবং তাহার উপরেও কিছু উপরি-পাওনা জুটিল।
অত্যন্ত মুখ ভার করিয়া বলিলেন, “অনুপম,যাও, তুমি সভায় গিয়ে বোসো গে।”
শম্ভুনাথবাবু
বলিলেন, “না, এখন সভায়
বসিতে হইবে না। চলুন,
আগে আপনাদের খাওয়াইয়া দিই।” মামা বলিলেন, “সে কী কথা। লগ”
শম্ভুনাথবাবু
বলিলেন, “সেজন্য
কিছু ভাবিবেন না’এখন
উঠুন।”
লোকটি নেহাত
ভালোমানুষ-ধরনের, কিন্তু
ভিতরে বেশ একটু জোর আছে বলিয়া বোধ হইল। মামাকে উঠিতে হইল। বরযাত্রীদেরও আহার হইয়া
গেল। আয়োজনের আড়ম্বর ছিল না। কিন্তু রান্না ভালো এবং সমস্ত বেশ
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বলিয়া সকলেরই তৃপ্তি হইল।
বরযাত্রীদের
খাওয়া শেষ হইলে শম্ভুনাথবাবু আমাকে খাইতে বলিলেন। মামা বলিলেন, “সে কী কথা।
বিবাহের পূর্বে বর খাইবে কেমন করিয়া।”
এ সম্বন্ধে
মামার কোনো মতপ্রকাশকে তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তুমি কী বল।
বসিয়া যাইতে দোষ কিছু আছে?”
মূর্তিমতী মাতৃ-আজ্ঞা-স্বরূপে মামা উপস্থিত, তাঁর
বিরুদ্ধে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি আহারে বসিতে পারিলাম না।
তখন
শম্ভুনাথবাবু মামাকে বলিলেন, “আপনাদিগকে অনেক কষ্ট দিয়াছি। আমরা ধনী নই, আপনাদের
যোগ্য আয়োজন করিতে পারি নাই, ক্ষমা করিবেন। রাত হইয়া গেছে, আর আপনাদের কষ্ট বাড়াইতে ইচ্ছা করি না।
এখন তবে ” মামা বলিলেন, “তা, সভায় চলুন, আমরা তো
প্রস্তুত আছি।”
শম্ভুনাথ
বলিলেন, “তবে
আপনাদের গাড়ি বলিয়া দিই?”
মামা
আশ্চর্য হইয়া বলিলেন,
“ঠাট্টা করিতেছেন নাকি।”
শম্ভুনাথ
কহিলেন, “ঠাট্টা
তো আপনিই করিয়া সারিয়াছেন। ঠাট্টার সম্পর্কটাকে স্থায়ী করিবার ইচ্ছা আমার নাই।”
মামা দুই
চোখ এত বড়ো করিয়া মেলিয়া অবাক হইয়া রহিলেন।
শম্ভুনাথ
কহিলেন, “আমার
কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে করে তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।”
আমাকে একটি
কথা বলাও তিনি আবশ্যক বোধ করিলেন না। কারণ, প্রমাণ হইয়া গেছে, আমি কেহই
নই। তারপরে যা হইল সে আমি বলিতে ইচ্ছা করি না। ঝাড়লণ্ঠন ভাঙিয়া-চুরিয়া, জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড করিয়া, বরযাত্রের দল দক্ষযজ্ঞের পালা সারিয়া বাহির হইয়া গেল।
বাড়ি
ফিরিবার সময় ব্যান্ড রসনচৌকি ও কন্সর্ট একসঙ্গে বাজিল না এবং অভ্রের ঝাড়গুলো
আকাশের তারার উপর আপনাদের কর্তব্যের বরাত দিয়া কোথায় যে মহানির্বাণ লাভ করিল
সন্ধান পাওয়া গেল না।
বাড়ির সকলে
তো রাগিয়া আগুন। কন্যার পিতার এত গুমর! কলি যে চারপোয়া হইয়া আসিল! সকলে বলিল, “দেখি, মেয়ের বিয়ে
দেন কেমন করিয়া।” কিন্তু
মেয়ের বিয়ে হইবে না এ ভয় যার মনে নাই তার শাস্তির উপায় কি।
মস্ত
বাংলাদেশের মধ্যে আমিই একমাত্র পুরুষ যাহাকে কন্যার বাপ বিবাহের আসর হইতে নিজে
ফিরাইয়া দিয়াছে। এত বড়ো সৎপাত্রের কপালে এত বড়ো কলঙ্কের দাগ কোন নষ্ট গ্রহ এত আলো
জ্বালাইয়া, বাজনা
বাজাইয়া, সমারোহ
করিয়া আঁকিয়া দিল? বরযাত্রীরা
এই বলিয়া কপাল চাপড়াইতে লাগিল যে, “বিবাহ হইল না অথচ আমাদের ফাঁকি দিয়া
খাওয়াইয়া দিল’ পাকযন্ত্রটাকে
সমস্ত অন্নসুদ্ধ সেখানে টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া আসিতে পারিলে তবে আফসোস
মিটিত।”
বিবাহের
চুক্তিভঙ্গ ও মানহানির দাবিতে নালিশ করিব বলিয়া মামা অত্যন্ত গোল করিয়া বেড়াইতে
লাগিলেন। হিতৈষীরা বুঝাইয়া দিল, তাহা হইলে তামাশার যেটুকু বাকি আছে তাহা পুরা হইবে। বলা
বাহুল্য, আমিও
খুব রাগিয়াছিলাম। কোনো গতিকে শম্ভুনাথ বিষম জব্দ হইয়া আমাদের পায়ে ধরিয়া আসিয়া পড়েন, গোঁফের
রেখায় তা দিতে দিতে এইটেই কেবল কামনা করিতে লাগিলাম।
কিন্তু, এই আক্রোশের কালো
রঙের ¯স্রোতের পাশাপাশি আর একটা ¯স্রোত বহিতেছিল যেটার রঙ একেবারেই কালো
নয়। সমস্ত মন যে সেই অপরিচিতার পানে ছুটিয়া গিয়াছিল’ এখনো যে
তাহাকে কিছুতেই টানিয়া ফিরাইতে পারি না। দেয়ালটুকুর আড়ালে রহিয়া গেল গো। কপালে তার
চন্দন আঁকা, গায়ে
তার লাল শাড়ি, মুখে
তার লজ্জার রক্তিমা,
হৃদয়ের ভিতরে কী যে তা কেমন করিয়া বলিব। আমার কল্পলোকের কল্পলতাটি বসন্তের
সমস্ত ফুলের ভার আমাকে নিবেদন করিয়া দিবার জন্য নত হইয়া পড়িয়াছিল। হাওয়া আসে, গন্ধ পাই, পাতার শব্দ
শুনি’ কেবল
আর একটিমাত্র পা ফেলার অপেক্ষা’এমন সময়ে সেই এক পদক্ষেপের দূরত্বটুকু এক মুহূর্তে অসীম
হইয়া উঠিল!
এতদিন যে
প্রতি সন্ধ্যায় আমি বিনুদাদার বাড়িতে গিয়া তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিলাম!
বিনুদার বর্ণনার ভাষা অত্যন্ত সংকীর্ণ বলিয়াই তাঁর প্রত্যেক কথাটি স্ফূলিঙ্গের মতো
আমার মনের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়া দিয়াছিল। বুঝিয়াছিলাম মেয়েটির রূপ বড়ো আশ্চর্য; কিন্তু না
দেখিলাম তাহাকে চোখে,
না দেখিলাম তাহার ছবি, সমস্তই অস্পষ্ট হইয়া রহিল। বাহিরে তো সে ধরা দিলই না, তাহাকে মনেও
আনিতে পারিলাম না’এইজন্য
মন সেদিনকার সেই বিবাহসভার দেয়ালটার বাহিরে ভূতের মতো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বেড়াইতে
লাগিল।
হরিশের কাছে
শুনিয়াছি, মেয়েটিকে
আমার ফটোগ্রাফ দেখানো হইয়াছিল। পছন্দ করিয়াছে বৈকি। না করিবার তো কোনো কারণ নাই।
আমার মন বলে, সে
ছবি তার কোনো একটি বাক্সের মধ্যে লুকানো আছে। একলা ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া এক’একদিন
নিরালা দুপুরবেলায় সে কি সেটি খুলিয়া দেখে না? যখন ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখে তখন ছবিটির
উপরে কি তার মুখের দুই ধার দিয়া এলোচুল আসিয়া পড়ে না? হঠাৎ বাহিরে
কারও পায়ের শব্দ পাইলে সে কি তাড়াতাড়ি তার সুগন্ধ আঁচলের মধ্যে ছবিটিকে লুকাইয়া
ফেলে না? দিন
যায়। একটা বৎসর গেল। মামা তো লজ্জায় বিবাহসম্বন্ধের কথা তুলিতেই পারেন না। মার
ইচ্ছা ছিল, আমার
অপমানের কথা যখন সমাজের লোকে ভুলিয়া যাইবে তখন বিবাহের চেষ্টা দেখিবেন।
এদিকে আমি
শুনিলাম সে মেয়ের নাকি ভালো পাত্র জুটিয়াছিল, কিন্তু সে পণ করিয়াছে বিবাহ করিবে না।
শুনিয়া আমার মন পুলকের আবেশে ভরিয়া গেল। আমি কল্পনায় দেখিতে লাগিলাম, সে ভালো
করিয়া খায় না; সন্ধ্যা
হইয়া আসে, সে
চুল বাঁধিতে ভুলিয়া যায়। তার বাপ তার মুখের পানে চান আর ভাবেন, “আমার মেয়ে
দিনে দিনে এমন হইয়া যাইতেছে কেন।” হঠাৎ কোনোদিন তার ঘরে আসিয়া দেখেন, মেয়ের দুই
চক্ষু জলে ভরা।
জিজ্ঞাসা
করেন, “মা, তোর কী
হইয়াছে বল আমাকে।” মেয়ে
তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া বলে, “কই কিছুই তো হয় নি বাবা।” বাপের এক মেয়ে যে-বড়ো আদরের মেয়ে। যখন
অনাবৃষ্টির দিনে ফুলের কুঁড়িটির মতো মেয়ে একেবারে বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছে তখন বাপের
প্রাণে আর সহিল না। তখন অভিমান ভাসাইয়া দিয়া তিনি ছুটিয়া আসিলেন আমাদের দ্বারে।
তার পরে? তার
পরে মনের মধ্যে সেই যে কালো রঙের ধারাটা বহিতেছে সে যেন কালো সাপের মতো রূপ ধরিয়া
ফোঁস করিয়া উঠিল। সে বলিল, “বেশ তো, আর একবার বিবাহের আসর সাজানো হোক, আলো জ¦লুক, দেশ-বিদেশের
লোকের নিমন্ত্রণ হোক,
তার পরে তুমি বরের টোপর পায়ে দলিয়া দলবল লইয়া সভা ছাড়িয়া চলিয়া এসো।” কিন্তু, যে ধারাটি
চোখের জলের মতো শুভ্র সে রাজহংসের রূপ ধরিয়া বলিল, “যেমন করিয়া আমি একদিন দময়ন্তীর
পুষ্পবনে গিয়াছিলাম,
তেমনি করিয়া আমাকে একবার উড়িয়া যাইতে দাও’আমি বিরহিণীর কানে কানে একবার সুখের
খবরটা দিয়া আসি গে।”
তার পরে? তার
পরে দুঃখের রাত পোহাইল, নববর্ষার জল পড়িল, ম্লান ফুলটি মুখ তুলিল’এবারে সেই
দেয়ালটার বাহিরে রহিল সমস্ত
পৃথিবীর আর
সবাই আর ভিতরে প্রবেশ করিল একটিমাত্র মানুষ। তার পরে? তার পরে
আমার কথাটি ফুরালো।

কিন্তু, কথা এমন
করিয়া ফুরাইল না। যেখানে আসিয়া তাহা অফুরান হইয়াছে সেখানকার বিবরণ একটুখানি বলিয়া
আমার এ লেখা শেষ করিয়া দিই।
মাকে লইয়া
তীর্থে চলিয়াছিলাম। আমার উপরেই ভার ছিল। কারণ মামা এবারেও হাবড়ার পুল পার হন নাই।
রেলগাড়িতে ঘুমাইতেছিলাম। ঝাঁকানি খাইতে খাইতে মাথার মধ্যে নানাপ্রকার এলোমেলো
স্বপেড়বর ঝুমঝুমি বাজিতেছিল। হঠাৎ একটা কোন স্টেশনে জাগিয়া উঠিলাম। আলোতে অন্ধকার
মেশা সেও এক স্বপ্ন। কেবল আকাশের তারাগুলি চিরপরিচিত’ আর সবই
অজানা অস্পষ্ট; স্টেশনের
দীপ-কয়টা খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া আলো ধরিয়া এই পৃথিবীটা যে কত অচেনা এবং যাহা চারিদিকে
তাহা যে কতই বহু দূরে তাহাই দেখাইয়া দিতেছে।
গাড়ির মধ্যে
মা ঘুমাইতেছেন; আলোর
নিচে সবুজ পর্দা টানা;
তোরঙ্গ বাক্স জিনিসপত্র সমস্তই কে কার ঘাড়ে এলোমেলো হইয়া রহিয়াছে, তাহারা যেন
স্বপড়বলোকের উলট-পালট আসবাব, সবুজ প্রদোষের মিটমিটে আলোতে
থাকা এবং
না-থাকার মাঝখানে কেমন একরকম হইয়া পড়িয়া আছি।
এমন সময়ে
সেই অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত রাত্রে কে বলিয়া উঠিল, “শিগগির চলে আয় এই গাড়িতে জায়গা আছে।” মনে হইল, যেন গান
শুনিলাম। বাঙালি মেয়ের গলায় বাংলা কথা যে কী মধুর তাহা এমনি করিয়া অসময়ে অজায়গায়
আচমকা শুনিলে তবে সম্পূর্ণ বুঝিতে পারা যায়। কিন্তু, এই গলাটিকে কেবলমাত্র মেয়ের
গলা বলিয়া
একটি শ্রেণিভুক্ত করিয়া দেওয়া চলে না, এ কেবল একটি মানুষের গলা; শুনিলেই মন
বলিয়া ওঠে, “এমন
তো আর শুনি নাই।”
চিরকাল গলার
স্বর আমার কাছে বড়ো সত্য। রূপ জিনিসটি বড়ো কম নয়, কিন্তু মানুষের মধ্যে যাহা অন্তরতম এবং
অনির্বচনীয়, আমার
মনে হয় কণ্ঠস্বর যেন তারই চেহারা। আমি তাড়াতাড়ি গাড়ির জানালা খুলিয়া বাহিরে মুখ
বাড়াইয়া দিলাম, কিছুই
দেখিলাম না। প্লাটফর্মের অন্ধকারে দাঁড়াইয়া গার্ড তাহার একচক্ষু লণ্ঠন নাড়িয়া দিল, গাড়ি চলিল; আমি জানলার
কাছে বসিয়া রহিলাম। আমার চোখের সামনে কোনো মূর্তি ছিল না, কিন্তু
হৃদয়ের মধ্যে আমি একটি হৃদয়ের রূপ দেখিতে লাগিলাম। সে যেন এই তারাময়ী রাত্রির মতো, আবৃত করিয়া
ধরে কিন্তু তাহাকে ধরিতে পারা যায় না। ওগো সুর, অচেনা কণ্ঠের সুর, এক নিমেষে
তুমি যে আমার চিরপরিচয়ের আসনটির উপরে আসিয়া বসিয়াছ। কী আশ্চর্য পরিপূর্ণ তুমি’ চঞ্চল কালের
ক্ষুব্ধ হৃদয়ের উপরে ফুলটির মতো ফুটিয়াছ, অথচ তার ঢেউ লাগিয়া একটি
পাপড়িও টলে নাই, অপরিমেয়
কোমলতায় এতটুকু দাগ পড়ে নাই।
গাড়ি লোহার
মৃদঙ্গে তাল দিতে দিতে চলিল; আমি মনের মধ্যে গান শুনিতে শুনিতে চলিলাম। তাহার একটিমাত্র
ধুয়া’“গাড়িতে
জায়গা আছে।” আছে
কি, জায়গা
আছে কি। জায়গা যে পাওয়া যায় না, কেউ যে কাকেও চেনে না। অথচ সেই না-চেনাটুকু যে কুয়াশামাত্র, সে যে মায়া, সেটা ছিন্ন হইলেই যে চেনার আর অন্ত নাই। ওগো সুধাময় সুর, যে হৃদয়ের
অপরূপ রূপ তুমি, সে
কি আমার চিরকালের চেনা নয়। জায়গা আছে আছে’শীঘ্র আসিতে ডাকিয়াছ, শীঘ্রই
আসিয়াছি, এক
নিমেষও দেরি করি নাই।
রাত্রে ভালো
করিয়া ঘুম হইল না। প্রায় প্রতি স্টেশনে একবার করিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিলাম, ভয় হইতে
লাগিল যাহাকে দেখা হইল না সে পাছে রাত্রে নামিয়া যায়।
পরদিন সকালে
একটা বড়ো স্টেশনে গাড়ি বদল করিতে হইবে। আমাদের ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট’মনে আশা ছিল, ভিড় হইবে
না। নামিয়া দেখি, প্লাটফর্মে
সাহেবেদের আর্দালি-দল আসবাবপত্র লইয়া গাড়ির জন্য অপেক্ষা
করিতেছে।
কোন এক ফৌজের বড় জেনারেল সাহেব ভ্রমণে বাহির হইয়াছেন। দুই-তিন মিনিট পরেই গাড়ি
আসিল। বুঝিলাম, ফার্স্ট
ক্লাসের আশা ত্যাগ করিতে হইবে। মাকে লইয়া কোন গাড়িতে উঠি সে এক বিষম ভাবনায়
পড়িলাম। সব গাড়িতেই ভিড়। দ্বারে দ্বারে উঁকি মারিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। এমন সময়ে
সেকেন্ড ক্লাসের গাড়ি হইতে একটি মেয়ে আমার মাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “আপনারা
আমাদের গাড়িতে আসুন না’ এখানে জায়গা আছে।”
আমি তো
চমকিয়া উঠিলাম। সেই আশ্চর্যমধুর কণ্ঠ এবং সেই গানেরই ধুয়া’“জায়গা আছে।” ক্ষণমাত্র
বিলম্ব না করিয়া মাকে লইয়া গাড়িতে উঠিয়া পড়িলাম। জিনিসপত্র তুলিবার প্রায় সময় ছিল
না। আমার মতো অক্ষম
দুনিয়ায়
নাই। সেই মেয়েটিই কুলিদের হাত হইতে তাড়াতাড়ি চলতি গাড়িতে আমাদের বিছানাপত্র টানিয়া
লইল। আমার একটা ফটোগ্রাফ তুলিবার ক্যামেরা স্টেশনেই পড়িয়া রহিল’গ্রাহ্যই
করিলাম না।
তার পরে-কী লিখিব
জানি না। আমার মনের মধ্যে একটি অখ- আনন্দের ছবি আছে-তাহাকে কোথায় শুরু করিব, কোথায় শেষ
করিব? বসিয়া
বসিয়া বাক্যের পর বাক্য যোজনা করিতে ইচ্ছা করে না।
এবার সেই
সুরটিকে চোখে দেখিলাম;
তখনো তাহাকে সুর বলিয়াই মনে হইল। মায়ের মুখের দিকে চাহিলাম; দেখিলাম
তাঁর চোখে পলক পড়িতেছে না। মেয়েটির বয়স ষোলো কি সতেরো হইবে, কিন্তু
নবযৌবন ইহার
দেহে মনে
কোথাও যেন একটুও ভার চাপাইয়া দেয় নাই। ইহার গতি সহজ, দীপ্তি নির্মল, সৌন্দর্যের
শুচিতা অপূর্ব, ইহার
কোনো জায়গায় কিছু জড়িমা নাই।
আমি
দেখিতেছি, বিস্তারিত
করিয়া কিছু বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। এমন-কি সে যে কী রঙের কাপড় কেমন করিয়া পরিয়াছিল
তাহাও ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না। এটা খুব সত্য যে, তার বেশে ভূষায় এমন কিছুই ছিল না যেটা
তাহাকে ছাড়াইয়া বিশেষ করিয়া চোখে পড়িতে পারে। সে নিজের চারিদিকের সকলের চেয়ে অধিক-রজনীগন্ধার
শুভ্র মঞ্জরীর মতো সরল বৃন্তটির উপরে দাঁড়াইয়া, যে গাছে ফুটিয়াছে সে গাছকে সে একেবারে
অতিμম
করিয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে দুটি-তিনটি ছোটো ছোটো মেয়ে ছিল, তাহাদিগকে
লইয়া তাহার হাসি এবং কথার আর অন্ত ছিল না। আমি হাতে একখানা বই লইয়া সে দিকে কান
পাতিয়া রাখিয়াছিলাম। যেটুকু কানে আসিতেছিল সে তো সমস্তই ছেলেমানুষদের সঙ্গে
ছেলেমানুষি কথা। তাহার বিশেষত্ব এই যে, তাহার মধ্যে বয়সের তফাত কিছুমাত্র ছিল
না-ছোটদের
সঙ্গে সে অনায়াসে এবং আনন্দে ছোট হইয়া গিয়াছিল। সঙ্গে
কতকগুলি
ছবিওয়ালা ছেলেদের গল্পের বই-তাহারই কোনো-একটা বিশেষ গল্প শোনাইবার জন্য মেয়েরা
তাহাকে ধরিয়া পড়িল। এ গল্প নিশ্চয় তারা বিশ-পঁচিশ বার শুনিয়াছে। মেয়েদের কেন যে এত
আগ্রহ তাহা বুঝিলাম। সেই সুধাকণ্ঠের সোনার কাঠিতে সকল কথা যে সোনা হইয়া ওঠে।
মেয়েটির সমস্ত শরীর মন যে একেবারে প্রাণে ভরা, তার সমস্ত
চলায় বলায় স্পর্শে প্রাণ ঠিকরিয়া ওঠে। তাই মেয়েরা যখন তার মুখে গল্প শোনে তখন গল্প
নয়, তাহাকেই
শোনে; তাহাদের
হৃদয়ের উপর প্রাণের ঝর্না ঝরিয়া পড়ে। তার সেই উদ্ভাসিত প্রাণ আমার সেদিনকার সমস্ত
সূর্যকিরণকে সজীব করিয়া তুলিল; আমার মনে হইল, আমাকে যে প্রকৃতি তাহার আকাশ দিয়া
বেষ্টন করিয়াছে সে ঐ তরুণীরই অক্লান্ত অম্লান প্রাণের বিশ্বব্যাপী বিস্তার। পরের
স্টেশনে পৌঁছিতেই খাবারওয়ালাকে ডাকিয়া সে খুব খানিকটা চানা-মুঠ কিনিয়া লইল এবং
মেয়েদের সঙ্গে মিলিয়া নিতান্ত
ছেলেমানুষের
মতো করিয়া কলহাস্য করিতে করিতে অসংকোচে খাইতে লাগিল। আমার প্রকৃতি যে জাল দিয়া
বেড়া-আমি
কেন বেশ সহজে হাসিমুখে মেয়েটির কাছে এই চানা একমুঠা চাহিয়া লইতে পারিলাম না। হাত
বাড়াইয়া দিয়া কেন আমার লোভ স্বীকার করিলাম না।
মা
ভালো-লাগা এবং মন্দ-লাগার মধ্যে দোমনা হইয়াছিলেন। গাড়িতে আমি পুরুষমানুষ, তবু ইহার
কিছুমাত্র সংকোচ নাই,
বিশেষত এমন লোভীর মতো খাইতেছে, সেটা ঠিক তাঁর পছন্দ হইতেছিল না; অথচ ইহাকে
বেহায়া বলিয়াও তাঁর ভ্রম হয় নাই। তাঁর মনে হইল, এ মেয়ের বয়স হইয়াছে কিন্তু শিক্ষা হয়
নাই। মা হঠাৎ কারও সঙ্গে আলাপ করিতে পারেন না। মানুষের সঙ্গে দূরে দূরে থাকাই তাঁর
অভ্যাস। এই মেয়েটির পরিচয় লইতে তাঁর খুব ইচ্ছা, কিন্তু স্বাভাবিক বাধা কাটাইয়া উঠিতে
পারিতেছিলেন না। এমন সময়ে গাড়ি একটা বড়ো স্টেশনে আসিয়া থামিল। সেই জেনারেল-সাহেবের
একদল অনুসঙ্গী এই স্টেশন হইতে উঠিবার উদ্যোগ করিতেছে। গাড়িতে কোথাও জায়গা নাই। বার
বার আমাদের গাড়ির সামনে দিয়া তারা ঘুরিয়া গেল। মা তো ভয়ে আড়ষ্ট, আমিও মনের
মধ্যে শান্তি পাইতেছিলাম না। গাড়ি ছাড়িবার অল্পকাল-পূর্বে একজন দেশি রেলওয়ে
কর্মচারী নাম-লেখা দুইখানা টিকিট গাড়ির দুই বেঞ্চের শিয়রের কাছে লটকাইয়া দিয়া
আমাকে বলিল, “এ
গাড়ির এই দুই বেঞ্চ আগে হইতেই দুই সাহেব রিজার্ভ
করিয়াছেন, আপনাদিগকে
অন্য গাড়িতে যাইতে হইবে।”
আমি তো
তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। মেয়েটি হিন্দিতে বলিল, “না, আমরা গাড়ি
ছাড়িব না।” সে
লোকটি রোখ করিয়া বলিল,
“না ছাড়িয়া উপায় নাই।” কিন্তু মেয়েটির চলিষ্ণুতার কোনো লক্ষণ না দেখিয়া সে নামিয়া
গিয়া ইংরেজ স্টেশন-মাস্টারকে ডাকিয়া আনিল।
সে আসিয়া
আমাকে বলিল, “আমি
দুঃখিত, কিন্তু-” শুনিয়া আমি ‘কুলি কুলি’ করিয়া ডাক
ছাড়িতে লাগিলাম। মেয়েটি উঠিয়া দুই চক্ষে অগ্নিবর্ষণ করিয়া বলিল, “না, আপনি যাইতে
পারিবেন না, যেমন
আছেন বসিয়া থাকুন।” বলিয়া
সে দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া স্টেশন-মাস্টারকে ইংরেজি ভাষায় বলিল, “এ গাড়ি আগে
হইতে রিজার্ভ করা, এ
কথা মিথ্যা কথা।” বলিয়া
নাম লেখা টিকিটটি খুলিয়া প্লাটফর্মে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল।
ইতিমধ্যে
আর্দালি-সমেত ইউনিফর্ম-পরা সাহেব দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। গাড়িতে সে তার
আসবাব উঠাইবার জন্য আর্দালিকে প্রমে ইশারা করিয়াছিল। তাহার পর মেয়েটির মুখে
তাকাইয়া, তার
কথা শুনিয়া, ভাব
দেখিয়া, স্টেশন-মাস্টারকে
একটু স্পর্শ করিল এবং তাহাকে আড়ালে লইয়া গিয়া কী কথা হইল জানি না। দেখা গেল, গাড়ি
ছাড়িবার সময় অতীত হইলেও আর-একটা গাড়ি জুড়িয়া তবে ট্রেন ছাড়িল। মেয়েটি তার দলবল
লইয়া আবার একপত্তন চানা-মুঠ খাইতে শুরু করিল, আর আমি লজ্জায় জানলার বাহিরে মুখ
বাড়াইয়া
প্রকৃতির
শোভা দেখিতে লাগিলাম।
কানপুরে
গাড়ি আসিয়া থামিল। মেয়েটি জিনিসপত্র বাঁধিয়া প্রস্তুত-স্টেশনে
একটি হিন্দুস্থানি চাকর ছুটিয়া আসিয়া ইহাদিগকে নামাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিল।
মা তখন আর
থাকিতে পারিলেন না। জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী মা।”
মেয়েটি বলিল, “আমার নাম
কল্যাণী।” শুনিয়া
মা এবং আমি দুজনেই চমকিয়া উঠিলাম। “তোমার বাবা-” “তিনি
এখানকার ডাক্তার, তাঁহার
নাম শম্ভুনাথ সেন।” তার
পরেই সবাই নামিয়া গেল। মামার নিষেধ অমান্য করিয়া, মাতৃ-আজ্ঞা ঠেলিয়া, তার পরে আমি
কানপুরে আসিয়াছি। কল্যাণীর বাপ এবং কল্যাণীর সঙ্গে দেখা হইয়াছে। হাত জোড় করিয়াছি, মাথা হেঁট
করিয়াছি; শম্ভুনাথবাবুর
হৃদয় গলিয়াছে। কল্যাণী
বলে, “আমি বিবাহ
করিব না।” আমি
জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন।”
সে বলিল, “মাতৃ-আজ্ঞা।”
কী সর্বনাশ।
এ পক্ষেও মাতুল আছে নাকি। তার পরে বুঝিলাম, মাতৃভূমি আছে। সেই বিবাহ-ভাঙার পর হইতে
কল্যাণী মেয়েদের শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করিয়াছে।
কিন্তু আমি
আশা ছাড়িতে পারিলাম না। সেই সুরটি যে আমার হৃদয়ের মধ্যে আজও বাজিতেছে- সে যেন কোন
ওপারের বাঁশি-আমার
সংসারের বাহির হইতে আসিল-সমস্ত সংসারের বাহিরে ডাক দিল। আর, সেই-যে
রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে আমার কানে আসিয়াছিল “জায়গা আছে”, সে যে আমার
চিরজীবনের গানের ধুয়া হইয়া রহিল। তখন আমার বয়স ছিল তেইশ, এখন হইয়াছে
সাতাশ। এখনো আশা ছাড়ি নাই, কিন্তু মাতুলকে ছাড়িয়াছি। নিতান্ত এক ছেলে বলিয়া মা আমাকে
ছাড়িতে পারেন নাই। তোমরা মনে করিতেছ, আমি বিবাহের আশা করি? না, কোনো কালেই
না। আমার মনে আছে, কেবল
সেই এক রাত্রির অজানা কণ্ঠের মধুর সুরের আশা-জায়গা আছে। নিশ্চয়ই আছে। নইলে দাঁড়াব
কোথায়। তাই বৎসরের পর বৎসর যায় আমি এইখানেই আছি। দেখা হয়, সেই কণ্ঠ
শুনি, যখন
সুবিধা পাই কিছু তার কাজ করিয়া দিই-আর মন বলে, এই তো জায়গা
পাইয়াছি। ওগো অপরিচিতা, তোমার পরিচয়ের শেষ হইল না, শেষ হইবে
না; কিন্তু
ভাগ্য আমার ভালো, এই
তো আমি জায়গা পাইয়াছি।
শব্দার্থ ও
টীকা
👉 ‘এ জীবনটা না
দৈর্ঘ্যরে হিসাবে বড়ো,
না গুণের হিসাবে।’-
গল্পের কথক চরিত্র অনুপমের আত্মসমালোচনা। পরিমাণ ও গুণ উভয় দিক দিয়েই যে তার
জীবনটি নিতান্তই তুচ্ছ সে কথাই এখানে ব্যক্ত হয়েছে।
👉 ফলের মতো
গুটি - গুটি এক সময় পূর্ণ ফলে পরিণত হয়। কিন্তু গুটিই যদি ফলের মতো হয় তাহলে তার
অসম্পূর্ণ সারবত্তা প্রকট হয়ে ওঠে। নিজের নিষ্ফল জীবনকে বোঝাতে অনুপমের ব্যবহৃত
উপমা।
👉 মাকাল ফল -
দেখতে সুন্দর অথচ ভেতরে দুর্গন্ধ ও শাঁসযুক্ত খাওয়ার অনুপযোগী ফল। বিশেষ অর্থে
গুণহীন।
👉 অন্নপূর্ণা
- অন্নে পরিপূর্ণা। দেবী দুর্গা।
👉 গজানন - গজ
(হাতি) আনন যার। গণেশ।
👉 ‘আজও আমাকে
দেখিলে মনে হইবে, আমি
অন্নপূর্ণার কোলে
গজাননের
ছোটো ভাইটি।’ - দেবী
দুর্গার দুই পুত্র; অগ্রজ
গণেশ ও অনুজ কার্তিকেয়। দুর্গার কোলে থাকা দেব-সেনাপতি কার্তিকেয়কে বোঝানো হয়েছে।
ব্যঙ্গার্থে প্রয়োগ।
👉 ফল্গু -
ভারতের গয়া অঞ্চলের অন্তঃসলিলা নদী। নদীটির ওপরের অংশে বালির আস্তরণ কিন্তু ভেতরে
জল¯স্রোত প্রবাহিত।
👉 ‘ফল্গুর
বালির মতো তিনি আমাদের সমস্ত সংসারটাকে নিজের অন্তরের মধ্যে শুষিয়া লইয়াছেন।’ - অনুপম তার
মামার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে কথাটি বলেছে। সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব পালনে
তার ভূমিকা এখানে উপমার মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে।
👉 গণ্ডূষ - একমুখ বা এককোষ জল।
👉 অন্তঃপুর -
অন্দরমহল। ভেতরবাড়ি।
👉 স্বয়ংবরা -
যে মেয়ে নিজেই স্বামী নির্বাচন করে।
👉 গুড়গুড়ি -
আলবোলা। ফরসি। দীর্ঘ নলযুক্ত হুকাবিশেষ।
👉 বাঁধা হুঁকা
- সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য নারকেল-খোলে তৈরি ধূমপানের যন্ত্রবিশেষ।
👉 উমেদারি -
প্রার্থনা। চাকরির আশায় অন্যের কাছে ধরনা দেওয়া।
👉 অবকাশের
মরুভূমি এক - আনন্দহীন প্রচুর অবসর বোঝানো হয়েছে।
কালে ইহাদের
বংশে লক্ষ্মীর মঙ্গলঘট ভরা ছিল। - লক্ষ্মী ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী। মঙ্গলঘট তাঁর
প্রতীক। কল্যাণীদের বংশে একসময় লক্ষ্মীর কৃপায় ঐশ্বর্যের ঘট পূর্ণ ছিল।
👉 পশ্চিমে -
এখানে ভারতের পশ্চিম অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে।
👉 আন্ডামান
দ্বীপ - ভারতীয় সীমানাভুক্ত বঙ্গোপসাগরের দ্বীপবিশেষ। স্বদেশি আন্দোলনের যুগে
রাজবন্দিদের নির্বাসন শাস্তি দিয়ে আন্ডামান বা আন্দামানে পাঠানো হতো।
👉 কোন্নগর -
কলকাতার নিকটস্থ একটি স্থান।
👉মনু -
বিধানকর্তা বা শাস্ত্রপ্রণেতা মুনিবিশেষ।
👉 মনু সংহিতা
- মনু-প্রণীত মানুষের আচরণবিধি সংক্রান্ত গ্রন্থ।
👉 প্রজাপতি -
জীবের ¯স্রষ্টা। ব্রহ্মা। ইনি বিয়ের দেবতা।
👉 পঞ্চশর -
মদনদেবের ব্যবহার্য পাঁচ ধরনের বাণ।
👉 কন্সর্ট -
নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের ঐকতান।
👉 সেকরা -
স্বর্ণকার, সোনার
অলংকার প্রস্তুতকারক।
👉 ‘বর্বর
কোলাহলের মত্ত হস্তী দ্বারা সংগীতসরস্বতীর পদ্মবন দলিত বিদলিত করিয়া আমি তো বিবাহ-বাড়িতে
গিয়া উঠিলাম’ - অনুপম
নিজের বিবাহযাত্রার পরিস্থিতি বর্ণনায় সুরশূন্য বিকট কোলাহলকে সংগীত সরস্বতীর
পদ্মবন দলিত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছে।
👉 অভিষিক্ত -
অভিষেক করা হয়েছে এমন।
👉 সওগাদ -
উপঢৌকন। ভেট।
👉 লোক-বিদায় - পাওনা পরিশোধ। এখানে
অনুষ্ঠানের শেষে পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
👉 দেওয়া-থোওয়া
- বিয়ের যৌতুক ও আনুষঙ্গিক খরচ বোঝাতে কথাটি বলা হয়েছে।
👉 কষ্টিপাথর -
যে পাথরে ঘষে সোনার খাঁটিত্ব পরীক্ষা করা হয়।
👉 মকরমুখো
মোটা একখানা বালা - মকর বা কুমিরের মুখাকৃতিযুক্ত হাতে পরিধেয় অলংকারবিশেষ।
👉 এয়ারিং -
কানের দুল। Earring.
👉 দক্ষযজ্ঞ -
প্রজাপতি দক্ষ কর্তৃক অনুষ্ঠিত যজ্ঞ। এ যজ্ঞে পতিনিন্দা শুনে সতী দেহত্যাগ করেন।
স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ শুনে শিব অনুচরসহ যজ্ঞস্থলে পৌঁছে যজ্ঞ ধ্বংস করে দেন এবং
সতীর শব কাঁধে তুলে নিয়ে প্রলয় নৃত্যে মত্ত হন। এখানে প্রলয়কা- বা হট্টগোল
বোঝাচ্ছে।
👉 রসনচৌকি -
শানাই, ঢোল
ও কাঁসি- এই
তিন বাদ্যযন্ত্রে সৃষ্ট ঐকতানবাদন।
👉 অভ্র -এক
ধরনের খনিজ ধাতু। গরপধ
👉 অভ্রের ঝাড়
- অভ্রের তৈরি ঝাড়বাতি।
👉 মহানির্বাণ
- সবরকমের বন্ধন থেকে মুক্তি।
👉 কলি - পুরাণে বর্ণিত চার যুগের শেষ
যুগ। কলিযুগ। কলিকাল।
👉 কলি যে চারপোয়া হইয়া আসিল! - কলিকাল
পরিপূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করল।
👉 পাকযন্ত্র -
পাকস্থলী।
👉 প্রদোষ -
সন্ধ্যা।
👉 একচক্ষু
লণ্ঠন - একদিক খোলা তিনদিক ঢাকা বিশেষ ধরনের লণ্ঠন, যা রেলপথের সংকেত দেখানোর কাজে ব্যবহৃত
হয়।
👉 মৃদঙ্গ -
মাটির খোলের দুপাশে চামড়া লাগানো এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র।
👉 ‘গাড়ি লোহার
মৃদঙ্গে তাল দিতে দিতে চলিল।’ - চলন্ত রেলগাড়ির অবিরাম ধাতব ধ্বনি বোঝানো হয়েছে।
👉 ধুয়া -
গানের যে অংশ দোহাররা বারবার পরিবেশন করে।
👉 জড়িমা -
আড়ষ্টতা। জড়ত্ব।
👉 মঞ্জরী -
কিশলয়যুক্ত কচি ডাল। মুকুল
👉 একপত্তন -
একপ্রস্থ।
👉 কানপুর -
ভারতের একটি শহর।
👉 ‘তার পরে বুঝিলাম, মাতৃভূমি আছে।’ - কল্যাণী যে দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে, অনুপমের এই আত্মোপলব্ধি এখানে প্রকাশিত।

পাঠ-পরিচিতি:
“অপরিচিতা” প্রথম
প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার
১৩২১ বঙ্গাব্দের (১৯১৪) কার্তিক সংখ্যায়। এটি
প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয় রবীন্দ্রগল্পের সংকলন ‘গল্পসপ্তক’-এ এবং পরে, ‘গল্পগুচ্ছ’ তৃতীয়
খণ্ডে
(১৯২৭)। “অপরিচিতা” গল্পে
অপরিচিতা বিশেষণের আড়ালে যে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী নারীর কাহিনি বর্ণিত
হয়েছে, তার
নাম কল্যাণী। অমানবিক যৌতুক প্রথার নির্মম বলি হয়েছে এমন নারীদের গল্প ইতঃপূর্বে
রচনা করেছিলেন
রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু এই গল্পেই প্রথম যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের
কথকতা শোনালেন তিনি। এ গল্পে পিতা শম্ভুনাথ সেন এবং কন্যা কল্যাণীর স্বতন্ত্র
বীক্ষা ও আচরণে সমাজে গেড়ে-বসা ঘৃণ্য যৌতুকপ্রথা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। পিতার
বলিষ্ঠ প্রতিরোধ এবং কন্যা কল্যাণীর দেশচেতনায় ঋদ্ধ ব্যক্তিত্বের জাগরণ ও তার
অভিব্যক্তিতে গল্পটি সার্থক।
“অপরিচিতা” উত্তম
পুরুষের জবানিতে লেখা গল্প। গল্পের কথক অনুপম বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের যুদ্ধসংলগড়ব
সময়ের সেই বাঙালি যুবক, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর উপাধি অর্জন করেও ব্যক্তিত্বরহিত, পরিবারতন্ত্রের
কাছে
অসহায়
পুতুলমাত্র। তাকে দেখলে আজো মনে হয়, সে যেন মায়ের কোলসংলগড়ব শিশুমাত্র।
তারই বিয়ে উপলক্ষে যৌতুক নিয়ে নারীর চরম অবমাননাকালে শম্ভুনাথ সেনের
কন্যা-সম্প্রদানে অসম্মতি গল্পটির শীর্ষ মুহূর্ত। অনুপম নিজের গল্প বলতে গিয়ে
ব্যাঙ্গার্থে জানিয়ে দিয়েছে সেই অঘটন সংঘটনের কথাটি। বিয়ের লগড়ব যখন প্রস্তুত তখন
কন্যার লগড়বভ্রষ্ট হওয়ার লৌকিকতাকে অগ্রাহ্য করে শম্ভুনাথ সেনের নির্বিকার অথচ
বলিষ্ঠ প্রত্যাখ্যান নতুন এক সময়ের আশু আবির্ভাবকেই সংকেতবহ করে তুলেছে। কর্মীর
ভূমিকায় বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের জাগরণের মধ্য দিয়ে গল্পের শেষাংশে কল্যাণীর শুচিশুভ্র
আত্মপ্রকাশও ভবিষ্যতের নতুন নারীর আগমনীর ইঙ্গিতে পরিসমাপ্ত।
‘অপরিচিতা’ মনস্তাপে
ভেঙেপড়া এক ব্যক্তিত্বহীন যুবকের স্বীকারোক্তির গল্প, তার
পাপস্খালনের অকপট কথামালা। অনুপমের আত্মবিবৃতির সূত্র ধরেই গল্পের নারী কল্যাণী
অসামান্যা হয়ে উঠেছে। গল্পটিতে পুরুষতন্ত্রের অমানবিকতার স্ফুরণ যেমন ঘটেছে, তেমনি একই
সঙ্গে পুরুষের ভাষ্যে নারীর প্রশস্তিও কীর্তিত হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর:
০১. ‘ঠাট্টার
সর্ম্পকটাকে স্থায়ী করিবার ইচ্ছা আমার নাই।’ উক্তিটি- [ঢাবি
‘খ’ ২০১৭-১৮].উত্তর:
শম্ভনাথের। ০২. ‘অপরিচিতা’ গল্পে অনুপমের বন্ধু কে? [ঢাবি
‘গ’ ২০১৬-১৭]. উত্তর: হরিশ। ০৩. কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কোন নাটকটি কবি নজরুলকে উৎসগ করেছিলেন? [ঢাবি
‘গ’ ২০০৬-০৭, জবি ‘ক’ ২০১২-১৩,
চবি ‘ঙ’ ২০১০-১১] উত্তর: বসন্ত। ০৪.
রবীন্দ্রনাথের ‘অপরিচিতা’ গল্পের মূল
বিষয়বস্তু কী? [জাহা: বিশ্ব. ‘A' ২০১৭-২০১৮]. উত্তর: যৌতুক প্রথা। ০৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত নাটক- মুক্তির উপায়, চিরকুমার সভা, রথের রশি, তাসের দেশ।
[জাহা. বিশ্ব. `C1' ২০১৮-১৯]. তাঁর আরো নাটক- অচলায়তন, ডাকঘর, মুকুট, রক্তকরবী, রাজা
(১৯১০)। ০৬. ‘অপরিচিতা’
গল্পটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়? [চবি‘বি’ ২০১৬-১৭]. উত্তর: সবুজপত্র পত্রিকায়। ০৭.
কল্যাণীকে গল্পকথক কোন ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন? [ঢাবি ‘ঘ’ ২০১৮-১৯]. উত্তর: রজনীগন্ধা। ০৮. উত্তম পুরুষের
ভাষ্যে কাহিনী বর্ণনা হয়েছে কোন রাচনাটিতে উত্তর: অপরিচিত।০৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প রচনার স্বর্ণযুগ?
উত্তর: শিলাইদহে।১০. রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ কি? উত্তর: একটি নাটক।১১. ‘অপরিচিতা’ গল্পটি প্রথম সংকলিত হয় কোন গ্রন্থে?
উত্তর: গল্পসপ্তক গ্রন্থে।১২. ‘অপরিচাতা’ গল্পের কথক কে? উত্তর: অনুপম।১৩. ‘অপরিচিতা’ গল্পের কথকের বয়স কত ছিল?
উত্তর: সাতাশ।১৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন রচনাটি কাজী নজরুল ইসলামকে
উৎসর্গ করেন? উত্তর: বসন্ত।১৫. ছোটবেলায় অনুপম পণ্ডিতমশাইয়ের বিদ্রেুপের পাত্র
হয়েছিল কেন? উত্তর: সুন্দর চেহারার জন্য।১৬. ‘অপরিচিতা’ কার দৃষ্টিকোণে লেখ গল্প? উত্তর: উত্তম
পুরুষের।১৭. ‘সে’ গ্রন্থের রচয়িতার নাম কী? উত্তর:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।১৮. কল্যাণীর পিতার নাম কি? উত্তর: শম্ভুনাথ সেন।১৯. ‘অপরিচিতা’ গল্পের নায়কের চেহারা নিয়ে পণ্ডিতমশাই
কিসের তুলনা করতেন? উত্তর: শিমুল ফুল ও মাকাল ফল।২০. সে যে আমার চিরজীবনের ধুয়া হইয়া রহিল।’-এই বাক্যে
সে কে? উত্তর: কল্যাণী।
আমার পথ
লেখক-পরিচিতিঃ
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহাকুমার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫
এ মে (১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬) জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহম্মেদ এবং মাতার
নাম জাহেদা খাতুন। বাংলা সাহিত্যের একজন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসাবে তিনি সমধিক পরিচিত। তার রচিত উপন্যাস ‘বাধঁনহারা’ ‘মৃত্যু-ক্ষুধা’, ‘কুহিলিকা’ এবং গল্পগ্রন্থের মধ্যে ‘রিক্তের বাধঁন’, ‘ব্যথার দান’, শিউলি মালা’ এবং তার উল্লেখ্যযোগ্য প্রবন্ধের
মধ্যে ‘যুগ-বাণী’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’,
‘রুদ্র-মঙ্গল’, ‘ রাজবন্দিও জবান বন্দি’
কাজী নজরুল
ইসলাম ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ এ আগস্ট (১২ ই ভাদ্র ১৩৮৩) ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
নাটক সমূহ: আলেয়া ও মধুমালা পুতুলের বিয়ে দিয়ে ঝিলিমিলি
নাটক দেখতে গেল।
উপন্যাস: কুহেলিকা বাঁধনহারা হয়ে মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস
লেখল।
প্রবন্ধ: দুর্দিনের যাত্রী রুদ্রমঙ্গল রাজবন্দির জবানবন্দীর
যুগবাণী (প্রথম) রচনা করলো সুরবালা ও আর বললো
আমি মন্দির আর মসজিদ যাই হোক।
গল্প গ্রন্থ: শিউলিমালাকে পদ্মগোখরার কামড়ে ব্যথা পায়, তার বেদনায় জিনের বাদশা।
কাব্যগ্রন্থ সমূহ: অগ্নিবীণার ঝড়ে, দোলন চাপা, ঝিঙেফুল ফনিমনসা দোলে সাত ভাই চম্পা ছায়ানট প্রলয়শিখা ভাঙ্গারগানের
পূবের হাওয়া সন্ধ্যার চক্রবাক সর্বহারাদের হবে কি পাওয়া। হে সাম্যবাদী চিত্তনামা সিন্ধু
হিন্দোল জিঞ্জির ভেঙ্গে নতুন চাঁদ মরুভাস্কর তৈরী কর যা হবে শেষ সওগাত।
উৎস পরিচিতি
কোন রচনার জন্য
কবি নজরুলকে কারাভোগ করতে হয়?- আনন্দময়ীর আগমনে।
কবি তাঁর স্বীয়
সত্যকে কিভাবে অভিবাদন জানাচ্ছেন?- সালাম নমস্কার জানিয়ে।
কোন পথ কবির
কাছে বিপথের?- সত্যেও বিরোধী পথ।
কবিকে পথ দেখাবে
কে?- সত্য।
কে মিথ্যাকে
ভয় করে না?- যে মিথ্যাকে চেনে।
আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। আমার যাত্রা-শুরুর
আগে আমি সালাম জানাচ্ছি-নমস্কার করছি আমার সত্যকে। যে-পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ আর কোনো পথই আমার বিপথ নয়।
রাজভয়- লোকভয় কোনো ভয়ই আমায় বিপথে নিয়ে যাবে না। আমি
যদি সত্যি করে আমার সত্যকে চিনে থাকি, আমার অন্তরে মিথ্যার ভয় না
থাকে, তাহলে বাইরের কোনো ভয়ই আমার কিছু
করতে পারবে না। যার ভিতরে ভয়, সেই বাইরে ভয় পায়। অতএব যে
মিথ্যাকে চেনে, সে মিছামিছি তাকে ভয়ও করে না। যার
মনে
মিথ্যা, সে-ই মিথ্যাকে ভয় করে। নিজকে
চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি এত বড় একটা জোর আসে যে, সে আপন সত্য ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করে না- অর্থাৎ কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে
পারে না।
এই যে, নিজকে চেনা, আপনার সত্যকে আপনার গুরু, পথপ্রদর্শক কা-ারি বলে জানা, এটা দম্ভ নয়, অহংকার নয়। এটা আত্মকে চেনার সহজ স্বীকারোক্তি। আর যদি এটাকে
কেউ ভুল করে অহংকার বলে মনে করেন, তবু এটা মন্দের ভালো- অর্থাৎ
মিথ্যা বিনয়ের চেয়ে অনেক বেশি ভালো। অনেক সময় খুব বেশি বিনয় দেখাতে গিয়ে নিজের সত্যকে
অস্বীকার করে ফেলা হয়। ওতে মানুষকে μমেই ছোট করে ফেলে, মাথা নিচু করে আনে। ও রকম বিনয়ের চেয়ে অহংকারের পৌরুষ অনেক-অনেক
ভালো।
অতএব এই অভিশাপ-রথের সারথির স্পষ্ট কথা বলাটাকে কেউ যেন
অহংকার বা স্পর্ধা বলে ভুল না করেন। স্পষ্ট কথা বলায় একটা অবিনয় নিশ্চয় থাকে; কিন্তু তাতে কষ্ট পাওয়াটা দুর্বলতা। নিজকে চিনলে, নিজের সত্যকেই নিজের কর্ণধার মনে জানলে নিজের শক্তির ওপর অটুট
বিশ্বাস আসে। এই স্বাবলম্বন, এই নিজের ওপর অটুট বিশ্বাস
করতেই শেখাচ্ছিলেন মহাত্মা গান্ধীজি। কিন্তু আমরা তাঁর কথা বুঝলাম না, “আমি আছি” এই কথা না বলে সবাই বলতে
লাগলাম “গান্ধীজি আছেন”। এই পরাবলম্বনই আমাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেললে। একেই বলে
সবচেয়ে বড় দাসত্ব। অন্তরে যাদের এত গোলামির ভাব, তারা বাইরের গোলামি থেকে রেহাই পাবে কী করে? আত্মাকে চিনলেই আত্মনির্ভরতা আসে। এই আত্মনির্ভরতা যেদিন সত্যি
সত্যিই আমাদের আসবে, সেই দিনই আমরা স্বাধীন হব, তার আগে কিছুতেই নয়। নিজে নিষ্ক্রিয় থেকে অন্য একজন মহাপুরুষকে
প্রাণপণে ভক্তি করলেই যদি দেশ উদ্ধার হয়ে যেত, তাহলে এই দেশ এতদিন পরাধীন থাকত না। আত্মকে চেনা নিজের সত্যকে বড় মনে করার দম্ভ-
আর যাই হোক ভ-ামি নয়। এ-দম্ভ শির উঁচু করে,
পুরুষ করে, মনে একটা ‘ডোন্ট কেয়ার’-ভাব আনে। আর যাদের এই তথাকথিত দম্ভ আছে, শুধু তারাই অসাধ্য সাধন করতে পারবে।
যার ভিত্তি পচে গেছে, তাকে একদম উপড়ে ফেলে নতুন করে ভিত্তি না গাঁথলে তার ওপর ইমারত যতবার খাড়া করা যাবে, ততবারই তা পড়ে যাবে। দেশের যারা শত্রু, দেশের যা-কিছু মিথ্যা,
ভ-ামি, মেকি তা সব দূর করতে প্রয়োজন হবে আগুনের সম্মার্জনা! আমার এমন
গুরু কেউ নেই, যার খাতিরে সে আগুন-সত্যকে অস্বীকার
করে কারুর মিথ্যা বা ভ-ামিকে প্রশ্রয় দেবে। আমি সে-দাসত্ব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। আমি
কোনো দিনই কারুর বাণীকে বেদবাক্য বলে মেনে নেব না, যদি তার সত্যতা প্রাণে তার সাড়া না দেয়। না বুঝে বোঝার ভ-ামি করে পাঁচ জনের শ্রদ্ধা
আর প্রশংসা পাবার লোভ আমি কোনো দিনই করব না।
ভুলের মধ্য দিয়ে গিয়েই তবে সত্যকে পাওয়া যায়। কোনো ভুল
করছি বুঝতে পারলেই আমি প্রাণ খুলে তা স্বীকার করে নেব। কিন্তু না বুঝেও নয়, ভয়েও নয়। ভুল করছি বা করেছি বুঝেও শুধু জেদের খাতিরে বা গোঁ
বজায় রাখবার জন্যে ভুলটাকে ধরে থাকব না। তাহলে আমার আগুন সেই দিনই নিভে যাবে। একমাত্র
মিথ্যার জলই এই শিখাকে নিভাতে পারবে। তাছাড়া কেউ নিভাতে পারবে না।
মানুষ-ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের
অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা আমার এ পথের অন্যতম উদ্দেশ্য।
মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য,
কোনো হিংসার
দুশমনির ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্য ধর্মকে ঘৃণা
করতে পারে না। দেশের পক্ষে যা মঙ্গলকর বা সত্য, শুধু তাই লক্ষ্য করে এই আগুনের ঝান্ডা দুলিয়ে পথে বাহির হলাম।
[সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত]
শব্দার্থ ও টীকা
কর্ণধার: নেতৃত্ব
প্রদানের সামর্থ্য আছে এমন ব্যক্তি।
কুর্নিশ: অভিবাদন।
সম্মান প্রদর্শন।
অভিশাপ-রথের সারথি সমাজের নিয়ম পাল্টাতে গেলে বাধার
সম্মুখীন হতে হয়, সমাজরক্ষকদের আক্রমণের শিকার হতে
হয়। এ কথা জেনেও নজরুল তাঁর বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে
তিনি অভিশাপ হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। নিজেই বসেছেন রথচালক তথা সারথির আসনে।
মেকি- মিথ্যা, কপট। সম্মার্জনা মেজে ঘষে পরিষ্কার করা।
আগুনের ঝাণ্ডা- অগ্নিপতাকা। আগুনে সব শুদ্ধ করে নিয়ে
সত্যের পথে ওড়ানো নিশান।
গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
❓ বাংলাদেশের
বিদ্রোহী কবি বলা হয় কাকে?
উত্তর : বাংলাদেশের বিদ্রোহী কবি বলা হয় কাজী নজরুল ইসলামকে।
❓ বাংলাদেশের জাতীয় কবি বলা
হয় কাকে? উত্তর : কাজী নজরুল ইসলামকে।
❓ কাজী নজরুল ইসলাম কত খ্রিষ্টাব্দে
সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন?
উত্তর : ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।
❓ কাজী নজরুল ইসলাম কত বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন?
উত্তর
: ৪৩ বছর বয়সে
❓ কাজী নজরুল ইসলামের কবর কোথায়
অবস্থিত?
উত্তর : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের
পাশে অবস্থিত।
❓ ‘আমার পথ’ প্রবন্ধের প্রাবন্ধিক তাঁর পথ চলার আগে কাকে সালাম জানাচ্ছেন?
উত্তর : ‘তাঁর সত্যকে’ সালাম জানাচ্ছেন।
❓ ‘আমার পথ’ প্রবন্ধের কোন ভয় প্রাবন্ধিককে বিপথে নিয়ে যাবে না?
উত্তর : রাজভয়-লোকভয় প্রাবন্ধিককে বিপথে নিয়ে যাবে না।
❓ অন্তরে কোনো ‘আমার পথ’ প্রবন্ধের ভয় না থাকলে বাইরের
কোনো ভয়ই কিছু করতে পারে না?
উত্তর : অন্তরে ‘আমার পথ’ প্রবন্ধের মিথ্যার ভয় না
থাকলে বাইরের কোনো ভয়ই কিছু করতে পারে না।
❓ কে বাইরের ভয় পায়?
উত্তর : যার ভেতরে ভয় সে বাইরের ভয় পায়।
❓ কাজী নজরুল ইসলাম এর মতে, কী চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি একটা জোর আসে?
উত্তর : নিজেকে চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি
একটা জোর আসে।
❓ অনেক সময় কী দেখাতে গিয়ে
নিজের সত্যকে অস্বীকার করে ফেলা হয়?
উত্তর : অনেক সময় বিনয় দেখাতে গিয়ে নিজের সত্যকে
অস্বীকার করে ফেলা হয়।
❓ অতিরিক্ত বিনয় মানুষকে কী
করে?
উত্তর : অতিরিক্ত বিনয় মানুষকে ছোট করে।
❓ গান্ধীজি তাঁর দেশবাসীকে
কী শেখাচ্ছিলেন?
উত্তর : গান্ধীজি তার দেশবাসীকে স্বাবলম্বন শেখাচ্ছিলেন।
❓ কাজী নজরুল ইসলামের মতে, অন্তরে কী থাকলে বাইরের গোলামি ভাব থেকে রেহাই পাওয়া যায় না?
উত্তর : অন্তরে গোলামির ভাব থাকলে বাইরের গোলামিভাব
থেকে রেহাই পাওয়া যায় না।
❓ প্রাবন্ধিকের মতে, কী চিনলে আত্মনির্ভরতা আসে?
উত্তর : আত্মাকে চিনলে আত্মনির্ভরতা আসে।
❓ নজরুলের মতে, নিজে কী থেকে অন্য একজন মহাপুরুষকে প্রাণপণে ভক্তি করলেও দেশ
উদ্ধার হবে না?
উত্তর : নিজে থেকে অন্য একজন মহাপুরুষকে প্রাণপণে
ভক্তি করলেও দেশ উদ্ধার হবে না।
❓ ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে কাকে নিজের ভগবান মনে করা ভণ্ডামি নয়?
উত্তর : নিজ আত্মাকে নিজের ভগবান মনে করা ভণ্ডামি
নয়।
❓ কী থাকলে মানুষের ধর্মের
বৈষম্যের ভাব থাকে না?
উত্তর : আদম সত্যের মিল থাকলে মানুষের ধর্মের
বৈষম্যের ভাব থাকে না।
❓ নেতৃত্ব প্রদানের সামর্থ্য
আছে এমন ব্যক্তিকে কী বলা হয়?
উত্তর : নেতৃত্ব প্রদানের সামর্থ্য আছে এমন ব্যক্তিকে
কর্ণধার বলা হয়।
❓ ‘কুর্নিশ’ শব্দটির অর্থ কী?
উত্তর : ‘কুর্নিশ’ শব্দটির অর্থ অভিবাদন বা সম্মান প্রদর্শন।
❓ কী করতে গেলে বাধার সম্মুখীন
হতে হয়?
উত্তর : সমাজের নিয়ম পাল্টাতে গেলে বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
❓ সমাজের নিয়ম পাল্টাতে গেলে
কাদের আক্রমণের শিকার হতে হয়?
উত্তর : সমাজের নিয়ম পাল্টাতে গেলে সমাজ-রক্ষকদের
আক্রমণের শিকার হতে হয়।
❓ ‘মেকি’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর : মেকি শব্দের অর্থ কপট।
❓ ‘আগুনের ঝা-া’ শব্দটির অর্থ কী?
উত্তর : ‘আগুনের
ঝা-া’ শব্দটির অর্থ অগ্নিপতাকা।
❓ ‘আমার পথ’ প্রবন্ধটি কোন গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে?
উত্তর : ‘আমার
পথ’ প্রবন্ধটি ‘রুদ্র-মঙ্গল’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে।
❓ কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমি’ ভাবনা বিন্দুতে কীসের উচ্ছ্বাস
জাগায়।
উত্তর : কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমি’ ভাবনা বিন্দুতে সিন্ধুর উচ্ছ্বাস জাগায়?
❓ কাজী নজরুল ইসলাম মানুষকে
আরেক মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে কী হয়ে উঠতে চেয়েছেন?
উত্তর : কাজী নজরুল ইসলাম মানুষকে আরেক মানুষের
সঙ্গে মিলিয়ে ‘আমরা’ হয়ে উঠতে চেয়েছেন।
❓ কোনটি কাজী নজরুল ইসলামের
প্রাণ প্রাচুর্যের উৎস বিন্দু?
উত্তর : সত্যের উপলব্ধি কাজী নজরুল ইসলামের প্রাণ
প্রাচুর্যের উৎস বিন্দু।
০২. কাজী নজরুল ইসলাম কোন সনে মৃত্যুবরণ করেন?- ১৯৭৬ সালে।
বিলাসী
লেখক-পরিচিতি
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার
হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মতিলাল
চট্টোপাধ্যায়, জননী ভুবনমোহিনী দেবী। বাংলা
সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই ঔপন্যাসিকের ছেলেবেলা
কাটে দারিদ্র্যের মধ্যে। চব্বিশ বছর বয়সে মনের ঝোঁকে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ
করেছিলেন শরৎচন্দ্র। সংগীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতির সূত্রে ঘটনাচক্রে এক জমিদারের বন্ধু হয়েছিলেন তিনি; জীবিকার
তাগিদে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন বর্মা মুল্লুকে অর্থাৎ বর্তমান মিয়ানমারে।
শরৎচন্দ্র তাঁর জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র সব মানুষের চরিত্র ফুটিয়ে
তুলেছেন তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে। বিশেষ করে সমাজের নিচু তলার মানুষ তাঁর সৃষ্ট
চরিত্রে অপূর্ব মহিমা নিয়ে চিত্রিত হয়েছে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের
শিল্পীমানসের মৌলবৈশিষ্ট্য মানবতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা।
শরৎচন্দ্রের প্রথম মুদ্রিত রচনা কুন্তলীন পুরস্কারপ্রাপ্ত “মন্দির” নামে
একটি গল্প। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে : ‘দেবদাস’, ‘পল্লি-সমাজ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘গৃহদাহ’, ‘দেনাপাওনা’ ইত্যাদি।
এসব উপন্যাসে বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি অঙ্কনে
তিনি অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর বহু উপন্যাস ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায়
অনূদিত ও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তাঁর কয়েকটি উপন্যাস বিদেশি ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী
স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে তাঁকে
সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে। শরৎচন্দ্র ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই
জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
পাকা দুই μক্রোশ পথ
হাঁটিয়া স্কুলে বিদ্যা অর্জন করিতে যাই। আমি একা নই-দশ-বারোজন।
যাহাদেরই বাটী পল্লিগ্রামে, তাহাদেরই ছেলেদের শতকরা আশিজনকে
এমনি করিয়া বিদ্যালাভ করিতে হয়। ইহাতে লাভের অঙ্কে শেষ পর্যন্ত
একেবারে শূন্য না পড়িলেও, যাহা পড়ে, তাহাতে হিসাব করিবার পক্ষে এই কয়টা কথা চিন্তা করিয়া দেখিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যে ছেলেদের সকাল আটটার মধ্যে বাহির হইয়া যাতায়াতে চার -ক্রোশ পথ ভাঙিতে হয়-চার μক্রোশ
মানে আট মাইল নয়, ঢের বেশি-বর্ষার দিনে মাথার ওপর মেঘের জল পায়ের নিচে এক হাঁটু কাদা এবং গ্রীষ্মের
দিনে জলের বদলে কড়া সূর্য এবং কাদার বদলে ধুলার সাগর সাঁতার দিয়া স্কুল-ঘর করিতে হয়, সেই দুর্ভাগা বালকদের মা-সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি, তাহাদের
যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি লুকাইবেন, ভাবিয়া
পান না। তারপরে এই কৃতবিদ্য শিশুর দল বড় হইয়া একদিন গ্রামেই বসুন, আর ক্ষুধার জ্বালায় অন্যত্রই যান-তাঁদের
চার μক্রোশ
হাঁটা বিদ্যার তেজ আত্মপ্রকাশ করিবেই করিবে। কেহ কেহ বলেন শুনিয়াছি, আচ্ছা, যাঁদের ক্ষুধার জ্বালা, তাঁদের কথা না হয় নাই ধরিলাম কিন্তু যাঁদের সে জ্বালা নাই, তেমন সব ভদ্রলোকই বা কী সুখে গ্রাম ছাড়িয়া পলায়ন করেন? তাঁরা বাস করিতে থাকিলে তো পল্লির এত দুর্দশা হয় না।
ম্যালেরিয়া কথাটা না হয় নাই পাড়িলাম। সে থাক, কিন্তু
ওই চার μক্রোশ
হাঁটার জ্বালায় কত ভদ্রলোকেই যে ছেলে-পুলে লইয়া গ্রাম ছাড়িয়া শহরে পালান তাহার আর
সংখ্যা নাই। তারপরে একদিন ছেলে-পুলের পড়াও শেষ হয় বটে, তখন
কিন্তু শহরের সুখ-সুবিধা রুচি লইয়া আর তাদের গ্রামে ফিরিয়া আসা চলে না। কিন্তু থাক
এ-সকল বাজে কথা। স্কুলে যাই-দুμক্রোশের মধ্যে এমন আরও তো দুই তিনখানা গ্রাম পার হইতে হয়। কার বাগানে আম পাকিতে
শুরু করিয়াছে, কোন বনে বঁইচি ফল অপর্যাপ্ত
ফলিয়াছে, কার গাছে কাঁঠাল এই পাকিল বলিয়া, কার মর্তমান রম্ভার কাঁদি কাটিয়া লইবার অপেক্ষা মাত্র, কার কানাচে ঝোপের মধ্যে আনারসের গায়ে রং ধরিয়াছে, কার
পুকুরপাড়ের খেজুরমেতি কাটিয়া খাইলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা অল্প, এই সব খবর লইতেই সময় যায়, কিন্তু আসলে যা বিদ্যা-কামস্কাটকার রাজধানীর নাম কী এবং সাইবেরিয়ার খনির মধ্যে রূপা মেলে, না সোনা মেলে- এ সকল দরকারি তথ্য অবগত হইবার
ফুরসতই মেলে না। কাজেই একজামিনের সময় এডেন কী জিজ্ঞাসা
করিলে বলি পারশিয়ার বন্দর, আর হুমায়ুনের বাপের নাম জানিতে
চাহিলে লিখিয়া দিয়া আসি তোগলক খাঁ এবং আজ চল্লিশের কোঠা পার হইয়াও দেখি, ও-সকল বিষয়ের ধারণা প্রায় একরকমই আছে-তারপরে
প্রমোশনের দিন মুখ ভার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া কখনো বা দল বাঁধিয়া মতলব করি, মাস্টারকে ঠ্যাঙানো উচিত, কখনো বা ঠিক করি, অমন বিশ্রী স্কুল ছাড়িয়া দেওয়াই কর্তব্য। আমাদের গ্রামের একটি ছেলের সঙ্গে
মাঝে মাঝেই স্কুলের পথে দেখা হইত। তাহার নাম ছিল মৃত্যুঞ্জয়। আমাদের চেয়ে সে বয়সে
অনেক বড়। থার্ড ক্লাসে পড়িত। কবে সে যে প্রথম থার্ড ক্লাসে উঠিয়াছিল, এ খবর আমরা কেহই জানিতাম না- সম্ভবত তাহা প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণার বিষয় - আমরা কিন্তু তাহার ওই থার্ড ক্লাসটাই চিরদিন দেখিয়া আসিয়াছি। তাহার ফোর্থ ক্লাসে পড়ার ইতিহাসও কখনো শুনি নাই, সেকেন্ড
ক্লাসে উঠিবার খবরও কখনো পাই নাই। মৃত্যুঞ্জয়ের বাপ-মা, ভাই-বোন
কেহই ছিল না, ছিল শুধু গ্রামের এক প্রান্তে
একটা প্রকা- আম-কাঁঠালের বাগান, আর তার মধ্যে একটা প্রকাণ্ড পোড়োবাড়ি, আর ছিল এক জ্ঞাতি খুড়া। খুড়ার কাজ ছিল ভাইপোর নানাবিধ দুর্নাম রটনা করা-সে গাঁজা খায়, সে গুলি খায়, এমনি আরও কত কি! তাঁর আর একটা কাজ ছিল বলিয়া বেড়ানো, ওই বাগানের অর্ধেকটা তাঁর নিজের অংশ, নালিশ
করিয়া দখল করার অপেক্ষা মাত্র। অবশ্য দখল একদিন তিনি পাইয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে জেলা-আদালতে নালিশ করিয়া নয়-ওপরের আদালতের হুকুমে। কিন্তু সে কথা পরে হইবে।
মৃত্যুঞ্জয় নিজে রাঁধিয়া খাইত এবং আমের দিনে ওই আম-বাগানটা জমা দিয়াই তাহার
সারা বৎসরের খাওয়া-পরা চলিত এবং ভালো করিয়াই চলিত। যেদিন দেখা হইয়াছে, সেইদিনই দেখিয়াছি ছেঁড়া-খোঁড়া মলিন বইগুলি বগলে করিয়া
পথের এক ধার দিয়া নীরবে চলিয়াছে। তাহাকে কখনো কারও সহিত যাচিয়া আলাপ করিতে দেখি
নাই-বরঞ্চ উপযাচক হইয়া কথা কহিতাম আমরাই। তাহার প্রধান কারণ ছিল এই যে, দোকানের খাবার কিনিয়া খাওয়াইতে গ্রামের মধ্যে তাহার জোড়া ছিল না। আর শুধু
ছেলেরাই নয়। কত ছেলের বাপ কতবার যে গোপনে ছেলেকে দিয়া তাহার কাছে স্কুলের মাহিনা
হারাইয়া গেছে, বই চুরি গেছে ইত্যাদি বলিয়া টাকা
আদায় করিয়া লইত, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু ঋণ
স্বীকার করা তো দূরের কথা, ছেলে তাহার সহিত একটা কথা
কহিয়াছে, এ কথাও কোনো বাপ ভদ্র সমাজে কবুল করিতে চাহিত না-গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের ছিল এমনি সুনাম।
অনেক দিন মৃত্যুঞ্জয়ের দেখা নাই। একদিন শোনা গেল সে মর-মর। আর একদিন শোনা
গেল,
মালোপাড়ার এক বুড়া মালো তাহার চিকিৎসা করিয়া এবং তাহার
মেয়ে বিলাসী সেবা করিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে যমের মুখ হইতে এ যাত্রা ফিরাইয়া আনিয়াছে।
অনেক দিন তাহার মিষ্টান্নের সদ্ব্যয় করিয়াছি- মনটা
কেমন করিতে লাগিল, একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে লুকাইয়া
তাহাকে দেখিতে গেলাম। তাহার পোড়োবাড়িতে প্রাচীরের বালাই নাই। স্বচ্ছন্দে ভিতরে
ঢুকিয়া দেখি, ঘরের দরজা
খোলা, বেশ উজ্জ্বল একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে, আর ঠিক সমুখেই তক্তপোষের ওপর পরিষ্কার ধবধবে বিছানায় মৃত্যুঞ্জয় শুইয়া আছে, তাহার কঙ্কালসার দেহের প্রতি চাহিলেই বুঝা যায়, বাস্তবিক
যমরাজ চেষ্টার ত্রুটি কিছু করেন নাই, তবে যে শেষ পর্যন্ত সুবিধা করিয়া উঠিতে পারেন নাই, সে কেবল ওই মেয়েটির জোরে। সে শিয়রে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছিল, অকস্মাৎ মানুষ দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। এই সেই বুড়া সাপুড়ের মেয়ে বিলাসী। তাহার বয়স আঠারো কি আটাশ ঠাহর করিতে পারিলাম না। কিন্তু
মুখের প্রতি চাহিবামাত্রই টের পাইলাম, বয়স যাই হোক, খাটিয়া খাটিয়া আর রাত জাগিয়া জাগিয়া ইহার শরীরে আর কিছু নাই। ঠিক যেন ফুলদানিতে জল দিয়া ভিজাইয়া রাখা বাসি ফুলের মতো।
হাত দিয়া এতটুকু স্পর্শ করিলে, এতটুকু নাড়াচাড়া করিতে গেলেই
ঝরিয়া পড়িবে। মৃত্যুঞ্জয় আমাকে চিনিতে পারিয়া
বলিল, “কে, ন্যাড়া?” বলিলাম, “হুঁ।”
মেয়েটা ঘাড় হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মৃত্যুঞ্জয় দুই-চারিটি কথায় যাহা কহিল, তাহার মর্ম এই যে, প্রায় দেড় মাস হইতে চলিল সে
শয্যাগত। মধ্যে দশ-পনের দিন সে অজ্ঞান অচৈতন্য
অবস্থায় পড়িয়াছিল, এই কয়েক দিন হইল সে লোক চিনিতে
পারিতেছে এবং যদিচ এখনো সে বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারে না, কিন্তু আর ভয় নাই।
ভয় নাই থাকুক। কিন্তু ছেলেমানুষ হইলেও এটা বুঝিলাম, আজও যাহার শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিবার ক্ষমতা হয় নাই, সেই রোগীকে এই বনের মধ্যে একাকী যে মেয়েটি বাঁচাইয়া তুলিবার ভার লইয়াছেন, সে কত বড় গুরুভার। দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি তাহার কত সেবা, কত শুশ্রূষা, কত
ধৈর্য, কত রাতজাগা। সে কত বড় সাহসের কাজ! কিন্তু যে
বস্তুটি এই অসাধ্য-সাধন করিয়া তুলিয়াছিল তাহার
পরিচয় যদিচ সেদিন পাই নাই, কিন্তু আর একদিন পাইয়াছিলাম।
ফিরিবার সময় মেয়েটি আর একটি প্রদীপ লইয়া আমার আগে আগে ভাঙা প্রাচীরের শেষ
পর্যন্ত আসিল। এতক্ষণ পর্যন্ত সে একটি কথাও কহে নাই, এইবার
আস্তে আস্তে বলিল, রাস্তা পর্যন্ত তোমায়
রেখে আসব কি? বড় বড় আমগাছে সমস্ত বাগানটা যেন একটা জমাট অন্ধকারের মতো বোধ হইতেছিল, পথ দেখা তো দূরের কথা, নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যায়
না। বলিলাম, “পৌঁছে দিতে হবে না, শুধু
আলোটা দাও।”
সে প্রদীপটা আমার হাতে দিতেই তাহার উৎকণ্ঠিত মুখের চেহারাটা আমার চোখে পড়িল।
আস্তে আস্তে সে বলিল, “একলা যেতে ভয় করবে না তো? একটু এগিয়ে দিয়ে আসব?” মেয়ে
মানুষ জিজ্ঞাসা করে, ভয় করবে না তো। সুতরাং মনে যাই
থাক,
প্রত্যুত্তরে শুধু একটা “না” বলিয়াই অগ্রসর হইয়া গেলাম। সে পুনরায় কহিল, “ঘন জঙ্গলের পথ, একটু দেখে পা ফেলে যেয়ো।”
সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল, কিন্তু এতক্ষণে বুঝিলাম, উদ্বেগটা তাহার কিসের জন্য এবং কেন সে আলো দেখাইয়া এই বনের পথ পার করিয়া
দিতে চাহিতেছিল। হয়ত সে নিষেধ শুনিত না, সঙ্গেই
যাইত, কিন্তু পীড়িত মৃত্যুঞ্জয়কে একাকী ফেলিয়া যাইতেই বোধ
করি তাহার শেষ পর্যন্ত মন সরিল না।
কুড়ি-পঁচিশ বিঘার বাগান। সুতরাং পথটা কম নয়। এই দারুণ
অন্ধকারের মধ্যে প্রত্যেক পদক্ষেপই বোধ করি ভয়ে ভয়ে করিতে হইত, কিন্তু পরক্ষণই মেয়েটির কথাতেই সমস্ত মন এমনি আচ্ছন্ন হইয়া রহিল যে, ভয় পাইবার আর সময় পাইলাম না। কেবল মনে হইতে লাগিল, একটা মৃতকল্প রোগী লইয়া থাকা কত কঠিন। মৃত্যুঞ্জয় তো যে-কোনো মুহূর্তেই মরিতে পারিত, তখন
সমস্ত রাত্রি এই বনের মধ্যে মেয়েটি একাকী কী করিত। কেমন করিয়া তাহার সে রাতটা
কাটিত। এই প্রসঙ্গে অনেকদিন পরের একটা কথা আমার মনে পড়ে। এক আত্মীয়ের মৃত্যুকালে
আমি উপস্থিত ছিলাম।
অন্ধকার রাত্রি-বাটীতে ছেলে-পুলে, চাকর-বাকর নাই, ঘরের মধ্যে শুধু তার সদ্যবিধবা
স্ত্রী আর আমি। তার স্ত্রী তো শোকের আবেগে দাপাদাপি করিয়া এমন কা- করিয়া তুলিলেন
যে,
ভয় হইল তাহারও প্রাণটা বুঝি বাহির হইয়া যায় বা!
কাঁদিয়া কাঁদিয়া বারবার আমাকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, তিনি
স্বেচ্ছায় যখন সহমরণে যাইতে চাহিতেছেন, তখন সরকারের কী? তাঁর যে আর তিলার্ধ বাঁচিতে সাধ নাই, এ কি
তাহারা বুঝিবে না?
তাহাদের ঘরে কি স্ত্রী নাই? তাহারা কি পাষাণ? আর এই রাত্রেই গ্রামের পাঁচজন যদি নদীর তীরের কোনো একটা জঙ্গলের মধ্যে তাঁর
সহমরণের যোগাড় করিয়া দেয় তো পুলিশের লোক জানিবে কী করিয়া? এমনি কত কি। কিন্তু আমার তো আর বসিয়া বসিয়া তাঁর কানড়বা শুনিলেই চলে না।
পাড়ায় খবর দেওয়া চাই-অনেক জিনিস যোগাড় করা চাই।
কিন্তু আমার বাহিরে যাইবার প্রস্তাব শুনিয়াই তিনি প্রকৃতিস্থ হইয়া উঠিলেন। চোখ
মুছিয়া বলিলেন, “ভাই, যা
হবার সে তো হইয়াছে, আর বাইরে গিয়া কী হইবে? রাতটা কাটুক না।”
বলিলাম, “অনেক কাজ, না গেলেই যে নয়।”
তিনি বলিলেন, “হোক কাজ, তুমি বসো।”
বলিলাম, “বসলে চলবে না, একবার খবর দিতেই হইবে”, বলিয়া পা বাড়াইবামাত্রেই তিনি
চিৎকার করিয়া উঠিলেন, “ওরে বাপরে! আমি একলা থাকতে পারব না।” কাজেই আবার বসিয়া পড়িতে হইল। কারণ, তখন
বুঝিলাম, যে স্বামী জ্যান্ত থাকতে তিনি নির্ভয়ে পঁচিশ বৎসর
একাকী ঘর করিয়াছেন, তাঁর মৃত্যুটা যদি-বা সহে তাঁর
মৃতদেহটা এই অন্ধকার রাত্রে পাঁচ মিনিটের জন্যও সহিবে না। বুক যদি কিছুতে ফাটে তো
সে এই মৃত স্বামীর কাছে একলা থাকিলে।
কিন্তু দুঃখটা তাহার তুচ্ছ করিয়া দেখানও আমার উদ্দেশ্য নহে। কিংবা তাহা
খাঁটি নয় এ কথা বলাও আমার অভিপ্রায় নহে। কিংবা একজনের ব্যবহারেই তাহার চূড়ান্ত
মীমাংসা হইয়া গেল তাহাও নহে। কিন্তু এমন আরও অনেক
ঘটনা জানি, যাহার উল্লেখ না করিয়াও আমি এই কথা বলিতে চাই যে, শুধু কর্তব্যজ্ঞানের জোরে অথবা বহুকাল ধরিয়া একসঙ্গে ঘর করার অধিকারেই এই
ভয়টাকে কোনো মেয়েমানুষই অতিμম করিতে পারে না। ইহা আর একটি শক্তি, যাহা বহু স্বামী-স্ত্রী একশ বৎসর
একত্রে ঘর করার পরেও হয়ত তাহার কোনো সন্ধান পায় না। কিন্তু
সহসা সে শক্তির পরিচয় যখন কোনো নরনারীর কাছে পাওয়া যায়, তখন
সমাজের আদালতে আসামি করিয়া তাহাদের দ- দেওয়ার আবশ্যক যদি হয় তো হোক, কিন্তু মানুষের যে বস্তুটি সামাজিক নয়, সে
নিজে যে ইহাদের দুঃখে গোপন অশ্রু বিসর্জন না করিয়া কোনো মতেই থাকিতে পারে না।
প্রায় মাস দুই মৃত্যুঞ্জয়ের খবর লই নাই। যাঁহারা পল্লিগ্রাম দেখেন নাই, কিংবা ওই রেলগাড়ির জানালায় মুখ বাড়াইয়া দেখিয়াছেন, তাঁহারা হয়ত সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিবেন, এ
কেমন কথা? এ কি কখনো সম্ভব হইতে পারে যে, অত বড় অসুখটা চোখে দেখিয়া আসিয়াও
মাস-দুই আর তার খবরই নাই। তাহাদের অবগতির জন্য বলা আবশ্যক যে, এ শুধু সম্ভব নয়, এ-ই হইয়া থাকে। একজনের বিপদে
পাড়াসুদ্ধ ঝাঁক বাঁধিয়া উপুড় হইয়া পড়ে, এই যে, একটা জনশ্রুতি আছে, জানি না তাহা সত্যযুগের পল্লিগ্রামে ছিল কি না, কিন্তু
একালে তো কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারি না। তবে তাহার মরার খবর যখন পাওয়া
যায় নাই, তখন সে যে বাঁচিয়া আছে এ ঠিক।
এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন কানে গেল, মৃত্যুঞ্জয়ের সেই বাগানের
অংশীদার খুড়া তোলপাড় করিয়া বেড়াইতেছেন যে, গেল
গেল,
গ্রামটা এবার রসাতলে গেল। নালতের মিত্তির বলিয়া সমাজে
আর তাঁর মুখ বাহির করিবার যো রহিল না-অকালকুষ্মাণ্ডটা একটা সাপুড়ের মেয়ে নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে। আর শুধু
নিকা নয়, তাও না হয় চুলায় যাক, তাহার
হাতে ভাত পর্যন্ত খাইতেছে। গ্রামে যদি ইহার শাসন না থাকে তো বনে গিয়া বাস করিলেই
তো হয়। কোড়োলা, হরিপুরের সমাজ একথা শুনিলে যে - ইত্যাদি ইত্যাদি।
তখন ছেলে বুড়ো সকলের মুখেই ওই এক কথা-অ্যাঁ
এ হইল কী? কলি কি সত্যই উল্টাইতে বসিল।
খুড়া বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, এ যে ঘটিবে তিনি অনেক আগেই
জানিতেন। তিনি শুধু তামাশা দেখিতেছিলেন, কোথাকার
জল কোথায় গিয়া পড়ে। নইলে পর নয়, প্রতিবেশী নয়, আপনার ভাইপো। তিনি কি বাড়ি লইয়া যাইতে
পারিতেন না? তাঁহার কি ডাক্তার-বৈদ্য দেখাইবার ক্ষমতা ছিল না? তবে কেন যে করেন নাই, এখন দেখুন সবাই।
কিন্তু আর তো চুপ করিয়া থাকা যায় না। এ যে মিত্তির
বংশের নাম ডুবিয়া যায়। গ্রামের যে মুখ পোড়ে। তখন আমরা গ্রামের লোক মিলিয়া
যে কাজটা করিলাম, তাহা মনে করিলে আমি আজও লজ্জায়
মরিয়া যাই।
খুড়া চলিলেন নালতের মিত্তির বংশের অভিভাবক হইয়া, আর
আমরা দশ-বারোজন সঙ্গে চলিলাম গ্রামের বদন দগ্ধ না হয় এইজন্য।
মৃত্যুঞ্জয়ের পোড়োবাড়িতে গিয়া যখন উপস্থিত হইলাম তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা
হইয়াছে। মেয়েটি ভাঙা বারান্দায় একধারে রুটি গড়িতেছে। অকস্মাৎ লাঠিসোটা হাতে এতগুলি
লোককে উঠানের ওপর দেখিয়া ভয়ে নীলবর্ণ
হইয়া গেল। খুড়া ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া দেখলেন, মৃত্যুঞ্জয়
শুইয়া আছে। চট করিয়া শিকলটা টানিয়া দিয়া সেই ভয়ে মৃতপ্রায় মেয়েটিকে সম্ভাষণ শুরু
করিলেন। বলা বাহুল্য, জগতের কোনো খুড়া কোনো কালে বোধ করি ভাইপোর-স্ত্রীকে ওরূপ সম্ভাষণ করে নাই। সে এমনি যে, মেয়েটি হীন সাপুড়ের মেয়ে হইয়াও তাহা সহিতে পারিল না, চোখ তুলিয়া বলিল, বাবা আমারে বাবুর সাথে
নিকা দিয়েছে জানো?
খুড়া বলিলেন তবে রে! ইত্যাদি ইত্যাদি এবং সঙ্গে সঙ্গেই দশ-বারোজন বীরদর্পে হুংকার দিয়া তাহার ঘাড়ে পড়িল। কেহ
ধরিল চুলের মুঠি, কেহ ধরিল কান, কেহ ধরিল হাত-দুটো এবং যাহাদের সে সুযোগ ঘটিল না তাহারাও নিশ্চেষ্ট হইয়া
রহিল না। কারণ, সংগ্রামস্থলে
আমরা কাপুরুষের ন্যায় চুপ করিয়া থাকিতে পারি, আমাদের
বিরুদ্ধে এত বড় দুর্নাম রটনা করিতে বোধ করি নারায়ণের কর্তৃপক্ষেরও চক্ষুলজ্জা
হইবে।
এইখানে একটা অবান্তর কথা বলিয়া রাখি। শুনিয়াছি নাকি বিলাত প্রভৃতি ম্লেচ্ছদেশে পুরুষদের মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে,
স্ত্রীলোক দুর্বল এবং নিরুপায় বলিয়া তাহার গায়ে হাত
তুলিতে নাই। এ আবার একটা কী কথা! সনাতন হিন্দু এ কুসংস্কার মানে না। আমরা বলি যাহারই
গায়ে জোর নাই, তাহারই গায়ে হাত তুলিতে পারা
যায়। তা সে নরনারী যাই হোক না কেন।
মেয়েটি প্রথমেই সেই যা একবার আর্তনাদ করিয়া উঠিয়াছিল, তারপর একেবারে চুপ করিয়া গেল। কিন্তু আমরা যখন তাহাকে গ্রামের বাহিরে রাখিয়া
আসিবার জন্য হিঁচড়াইয়া লইয়া চলিলাম, তখন মিনতি করিয়া বলিতে লাগিল, “বাবুরা, আমাকে একটিবার ছেড়ে দাও আমি রুটিগুলো ঘরে দিয়ে আসি। বাইরে শিয়াল কুকুরে খেয়ে
যাবে-রোগা মানুষ সমস্ত রাত খেতে পাবে না।”
মৃত্যুঞ্জয় রুদ্ধ ঘরের মধ্যে পাগলের মতো মাথা কুটিতে লাগিল, দ্বারে পদাঘাত করিতে লাগিল এবং শ্রাব্য-অশ্রাব্য বহুবিধ ভাষা প্রয়োগ করিতে লাগিল। কিন্তু আমরা
তাহাতে তিলার্ধ বিচলিত হইলাম না।
স্বদেশের মঙ্গলের জন্য সমস্ত অকাতরে সহ্য করিয়া টানিয়া লইয়া চলিলাম।
চলিলাম বলিতেছি, কেননা, আমিও বরাবর সঙ্গে ছিলাম, কিন্তু কোথায় আমার মধ্যে
একটুখানি দুর্বলতা ছিল, আমি তার গায়ে হাত দিতে পারি নাই।
বরঞ্চ কেমন যেন কানড়বা পাইতে লাগিল। সে যে অত্যন্ত অন্যায় করিয়াছে এবং তাহাকে গ্রামের বাহির করাই উচিত বটে, কিন্তু
এটাই যে আমরা ভালো কাজ করিতেছি সেও কিছুতেই মনে করিতে পারিলাম না। কিন্তু আমার কথা
থাক।
আপনারা মনে করিবেন না, পল্লিগ্রামে উদারতার একান্ত
অভাব। মোটেই না। বরঞ্চ বড়লোক হইলে আমরা এমন সব ঔদার্য প্রকাশ করি যে, শুনিলে আপনারা অবাক হইয়া যাইবেন।
এই মৃত্যুঞ্জয়টাই যদি না তাহার হাতে ভাত খাইয়া অমার্জনীয় অপরাধ করিত তাহা
হইলে তো আমাদের এত রাগ হইত না। আর কায়েতের ছেলের সঙ্গে
সাপুড়ের মেয়ের নিকা-এ তো একটা হাসিয়া উড়াইবার কথা কিন্তু কাল করিল যে ওই ভাত খাইয়া। হোক না সে আড়াই মাসের রোগী, হোক না সে শয্যাশায়ী কিন্তু তাই বলিয়া ভাত! লুচি নয়, সন্দেশ নয়, পাঁঠার মাংস নয়। ভাত খাওয়া যে
অন্ন-পাপ। সে তো আর সত্য সত্যই মাপ করা যায়
না। তা নইলে পল্লিগাঁয়ের লোক সংকীর্ণচিত্ত নয়। চার μক্রোশ হাঁটা বিদ্যা যেসব ছেলের পেটে তারাই তো একদিন বড় হইয়া সমাজের মাথা হয়।
দেবী বীণাপাণির বরে সংকীর্ণতা তাহাদের মধ্যে আসিবে কী করিয়া! এই তো ইহারই কিছুদিন পরে, প্রাতঃস্মরণীয়
স্বর্গীয় মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বিধবা পুত্রবধূ মনের বৈরাগ্যে বছর দুই কাশীবাস করিয়া
যখন ফিরিয়া আসিলেন, তখন
নিন্দুকেরা কানাকানি করিতে লাগিল যে, অর্ধেক সম্পত্তি ওই বিধবার এবং পাছে তাহা বেহাত হয় এই ভয়েই ছোটবাবু অনেক চেষ্টা, অনেক পরিশ্রমের পর বৌঠানকে যেখান হইতে ফিরাইয়া আনিয়াছেন, সেটা কাশীই বটে। যাই হোক, ছোটবাবু তাহার স্বাভাবিক ঔদার্যে
গ্রামের বারোয়ারি পূজাবাবদ দুইশত টাকা
দান করিয়া, পাঁচখানা গ্রামের ব্রাহ্মণের সদক্ষিণা-উত্তর ফলাহারের পর, প্রত্যেক সদব্রাহ্মণের হাতে যখন
একটা করিয়া কাঁসার গেলাস দিয়া বিদায় করিলেন, তখন
ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল। এমনকি, পথে আসিতে অনেকেই দশের এবং দেশের কল্যাণের নিমিত্ত কামনা করিতে লাগিলেন, এমন সব যারা বড়লোক তাদের বাড়িতে বাড়িতে, মাসে
মাসে এমন সদানুষ্ঠানের আয়োজন হয় না কেন?
কিন্তু যাক। মহত্ত্বের কাহিনি
আমাদের অনেক আছে। যুগে যুগে সঞ্চিত হইয়া প্রায় প্রত্যেক পল্লিবাসীর
দ্বারেই স্তূপাকার হইয়া উঠিয়াছে। এই দক্ষিণ বঙ্গের অনেক পল্লিতে অনেকদিন ঘুরিয়া
গৌরব করিবার মত অনেক বড় বড় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়াছি। চরিত্রেই
বল, ধর্মেই বল,
সমাজেই বল, আর বিদ্যাতেই বল, শিক্ষা একেবারেই পুরা হইয়া আছে; এখন
শুধু ইংরাজকে কষিয়া গালিগালাজ করিতে পারিলে দেশটা উদ্ধার হইয়া যায়। বৎসরখানেক গত হইয়াছে। মশার কামড় আর সহ্য করিতে না পারিয়া সবেমাত্র
সন্ন্যাসীগিরিতে ইস্তফা দিয়া ঘরে ফিরিয়াছি। একদিন দুপুরবেলা μক্রোশ দুই দূরের মালোপাড়ার ভিতর দিয়া চলিয়াছি, হঠাৎ দেখি, একটা কুটিরের দ্বারে বসিয়া মৃত্যুঞ্জয়। তাহার মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, বড় বড় দাড়ি-চুল, গলায় রুদ্রাক্ষ ও পুঁতির মালা-কে বলিবে এ আমাদের সেই মৃত্যুঞ্জয়। কায়স্থের ছেলে একটা বছরের মধ্যেই জাত
দিয়া একেবারে পুরাদস্তুর সাপুড়ে হইয়া
গিয়াছে। মানুষ কত শীঘ্র যে তাহার চৌদ্দ পুরুষের জাতটা বিসর্জন দিয়া আর একটা
জাত হইয়া উঠিতে পারে, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার।
ব্রাহ্মণের ছেলে মেথরানি বিবাহ করিয়া মেথর হইয়া গেছে এবং তাহাদের ব্যবসা অবলম্বন করিয়াছে, এ বোধ করি আপনারা সবাই
শুনিয়াছেন। আমি সদব্রাহ্মণের ছেলেকে এন্ট্রান্স পাস করার পরেও ডোমের মেয়ে বিবাহ
করিয়া ডোম হইতে দেখিয়াছি। এখন সে ধুচুনি কুলো বুনিয়া বিμয় করে, শুয়ার চরায়। ভালো কায়স্থ-সন্তানকে কসাইয়ের মেয়ে বিবাহ করিয়া
কসাই হইয়া যাইতেও দেখিয়াছি। আজ সে স্বহস্তে গরু কাটিয়া বিμয় করে-তাহাকে দেখিয়া কাহার সাধ্য বলে, কোনো কালে সে কসাই ভিন্ন আর কিছু ছিল। কিন্তু সকলেরই
ওই একই হেতু। আমার তাই তো মনে হয়, এমন করিয়া এত সহজে পুরুষকে
যাহারা টানিয়া নামাইতে পারে তাহারা কি এমনিই অবলীলাμমে
তাহাদের ঠেলিয়া উপরে তুলিতে পারে না? যে পল্লিগ্রামের পুরুষদের সুখ্যাতিতে আজ পঞ্চমুখ হইয়া উঠিয়াছি, গৌরবটা
কি একা শুধু তাহাদেরই? শুধু নিজেদের জোরেই এত দ্রুত
নিচের দিকে নামিয়া চলিয়াছে। অন্দরের দিক হইতে কি এতটুকু উৎসাহ, এতটুকু সাহায্য আসে না?
কিন্তু যাক। ঝোঁকের মাথায়, হয়ত বা অনধিকারচর্চা করিয়া বসিব।
কিন্তু আমার মুশকিল হইয়াছে যে, আমি কোনোমতেই ভুলিতে পারি না, দেশের নব্বই জন নরনারীই ওই পল্লিগ্রামেরই মানুষ এবং সেই জন্য কিছু একটা আমাদের করা চাই-ই। যাক। বলিতেছিলাম যে, দেখিয়া
কে বলিবে এ সেই মৃত্যুঞ্জয়। কিন্তু আমাকে সে খাতির করিয়া বসাইল। বিলাসী পুকুরে জল
আনিতে গিয়াছিল, আমাকে দেখিয়া সেও ভারি খুশি হইয়া
বার বার বলিতে লাগিল, “তুমি না আগলালে সে রাত্তিরে
আমাকে তারা মেরেই ফেলত। আমার জন্য না জানি কত মার তুমি খেয়েছিলে।”
কথায় কথায় শুনিলাম, পরদিনই তাহারা এখানে উঠিয়া আসিয়া
μমশ ঘর বাঁধিয়া বাস করিতেছে এবং সুখে আছে। সুখে যে আছে একথা আমাকে বলার
প্রয়োজন ছিল না, শুধু তাহাদের মুখের পানে চাহিয়াই
আমি তাহা বুঝিয়াছিলাম। তাই শুনিলাম, আজ কোথায় নাকি তাহাদের সাপ ধরার
বায়না আছে এবং তাহারা প্রস্তুত হইয়াছে, আমিও অমনি সঙ্গে যাইবার জন্য
লাফাইয়া উঠিলাম। ছেলেবেলা হইতেই দুটা জিনিসের ওপর আমার প্রবল শখ ছিল।
এক ছিল গোখরা সাপ ধরিয়া পোষা, আর ছিল মন্ত্র-সিদ্ধ হওয়া।
সিদ্ধা হওয়ার উপায় তখনও খুঁজিয়া বাহির করিতে পারি নাই। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়কে
ওস্তাদ লাভ করিবার আশায় আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম। সে তাহার নামজাদা শ্বশুরের
শিষ্য, সুতরাং মস্ত লোক। আমার ভাগ্য যে অকস্মাৎ এমন প্রসন্ন হইয়া উঠিবে তাহা কে ভাবিতে পারিত?
কিন্তু শক্ত কাজ এবং ভয়ের কারণ আছে বলিয়া প্রথমে তাহারা উভয়েই আপত্তি করিল, কিন্তু আমি এমনি নাছোড়বান্দা হইয়া উঠিলাম যে, মাস
খানেকের মধ্যে আমাকে সাগরেদ করিতে মৃত্যুঞ্জয় পথ পাইল না। সাপ ধরার মন্ত্র এবং
হিসাব শিখাইয়া দিল এবং কবজিতে ওষুধ সমেত মাদুলি বাঁধিয়া দিয়া দস্তুরমত সাপুড়ে
বানাইয়া তুলিল।
মন্ত্রটা কি জানেন? তার শেষটা আমার মনে আছে-
-ওরে কেউটে তুই মনসার বাহন-
মনসা দেবী আমার মা-
ওলটপালট পাতাল-ফোঁড়-
ঢোঁড়ার বিষ তুই নে, তোর বিষ ঢোঁড়ারে দে-
-দুধরাজ, মণিরাজ।
কার আজ্ঞা-বিষহরির আজ্ঞা।
ইহার মানে যে কী তাহা আমি জানি না। কারণ, যিনি
এই মন্ত্রেরও দ্রষ্টা ঋষি ছিলেন-নিশ্চয় কেহ না কেহ ছিলেন-তাঁর সাক্ষাৎ কখনও পাই নাই।
অবশেষে একদিন এই মন্ত্রের সত্য মিথ্যার চরম মীমাংসা হইয়া গেল বটে, কিন্তু যতদিন না হইল ততদিন সাপ ধরার জন্য চতুর্দিকে প্রসিদ্ধ হইয়া গেলাম।
সবাই বলাবলি করিতে লাগিল, হ্যাঁ, ন্যাড়া একজন গুণী লোক বটে।
সন্ন্যাসী অবস্থায় কামাখ্যায় গিয়া সিদ্ধ হইয়া আসিয়াছে। এতটুকু বয়সের মধ্যে
এত বড় ওস্তাদ হইয়া অহংকারে আমার মাটিতে পা পড়ে না, এমনি যো
হইল।
বিশ্বাস করিল না শুধু দুই জন। আমার গুরু যে, সে তো
ভালো মন্দ কোনো কথাই বলিত না। কিন্তু বিলাসী মাঝে মাঝে মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিত, ঠাকুর, এসব ভয়ংকর জানোয়ার, একটু সাবধানে নাড়াচাড়া করো।
বস্তুত বিষদাঁত ভাঙা, সাপের মুখ হইতে বিষ বাহির করা
প্রভৃতি কাজগুলো এমনি অবহেলার সহিত করিতে শুরু করিয়াছিলাম যে, সেসব মনে পড়িলে আমার আজও গা কাঁপে।
আসলে কথা হইতেছে এই যে, সাপ ধরাও কঠিন নয় এবং ধরা সাপ
দুই চারদিন হাঁড়িতে পুরিয়া রাখার পরে তাহার বিষদাঁত ভাঙাই হোক আর নাই হোক, কিছুতেই কামড়াইতে চাহে না। চμ তুলিয়া কামড়াইবার ভান করে, ভয় দেখায়, কিন্তু কামড়ায় না।
মাঝে মাঝে আমাদের গুরুশিষ্যের সহিত বিলাসী তর্ক করিত। সাপুড়েদের সবচেয়ে
লাভের ব্যবসা শিকড় বিক্রি করা, যা দেখাইবামাত্র সাপ পালাইতে পথ পায় না। কিন্তু তার পূর্বে সামান্য একটু কাজ
করিতে হইত। যে সাপটা শিকড় দেখিয়া পালাইবে, তাহার মুখে একটা লোহার শিক পুড়াইয়া বার কয়েক ছ্যাঁকা দিতে হয়। তারপর তাহাকে
শিকড়ই দেখান হোক বা একটা কাঠিই দেখান হোক, সে
কোথায় পালাইবে তা ভাবিয়া পায় না। এই কাজটার বিরুদ্ধে বিলাসী
ভয়ানক আপত্তি করিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে বলিত, “দেখ, এমন
করে মানুষ ঠকায়ো না।”
মৃত্যুঞ্জয় কহিত, “সবাই করে-এতে দোষ কী?”
বিলাসী বলিত, “করুক গে সবাই। আমাদের তো খাবার
ভাবনা নেই, আমরা কেন মিছামিছি
লোক ঠকাতে যাই।”
আর একটা জিনিস আমি বারবার লক্ষ করিয়াছি। সাপ ধরার বায়না আসিলেই বিলাসী
নানাপ্রকারে বাধা দিবার চেষ্টা করিত-আজ শনিবার, আজ মঙ্গলবার, এমনি কত কি। মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিত
না থাকিলে সে তো একবারেই ভাগাইয়া দিত, কিন্তু উপস্থিত থাকিলে মৃত্যুঞ্জয় নগদ টাকার লোভ সামলাইতে পারিত না। আর আমার
তো একরকম নেশার মত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। নানাপ্রকারে তাহাকে উত্তেজিত করিতে চেষ্টার
ত্রুটি করিতাম না।
বস্তুত ইহার মধ্যে মজা ছাড়া ভয় যে কোথায় ছিল, এ আমাদের
মনেই স্থান পাইত না। কিন্তু এই পাপের দ- আমাকে একদিন ভালো করিয়াই দিতে হইল।
সেদিন μক্রোশ-দেড়েক
দূরে এক গোয়ালার বাড়িতে সাপ ধরিতে গিয়াছি। বিলাসী বরাবরই সঙ্গে যাইত, আজও সঙ্গে ছিল। মেটে ঘরের মেঝে খানিকটা খুঁড়িতেই একটা গর্তের চিহ্ন পাওয়া
গেল। আমরা কেহই লক্ষ করি নাই, কিন্তু বিলাসী সাপুড়ের মেয়ে-সে হেঁট হইয়া কয়েক টুকরা কাগজ তুলিয়া লইয়া আমাকে বলিল, “ঠাকুর, একটু সাবধানে খুঁড়ো। সাপ একটা নয়
একজোড়া তো আছে বটেই হয়ত বা বেশি থাকিতে পারে।”
মৃত্যুঞ্জয় বলিল, “এরা যে বলে একটাই এসে ঢুকেছে।
একটাই দেখতে পাওয়া গেছে।” বিলাসী কাগজ দেখাইয়া কহিল, “দেখছ না বাসা করেছিল?”
মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “কাগজ তো ইঁদুরেও আনতে পারে।”
বিলাসী কহিল, “দু-ই হতে পারে। কিন্তু দুটো আছে
আমি বলছি।”
বাস্তবিক বিলাসীর কথাই ফলিল এবং মর্মান্তিকভাবেই সেদিন ফলিল। মিনিট-দশেকের
মধ্যে একটা প্রকা- খরিশ গোখরো ধরিয়া ফেলিয়া মৃত্যুঞ্জয় আমার হাতে দিল। কিন্তু
সেটাকে ঝাঁপির মধ্যে পুরিয়া ফিরিতে না ফিরিতেই মৃত্যুঞ্জয় ‘উঃ’ করিয়া নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার হাতের উলটা পিঠ দিয়ে ঝরঝর করিয়া রক্ত পড়িতেছিল।
প্রথমটা যেন সবাই হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম। কারণ সাপ ধরিতে গেলে সে পালাইবার জন্য
ব্যাকুল না হইয়া বরঞ্চ গর্ত হইতে একহাত মুখ বাহির করিয়া দংশন করে, এমন অভাবনীয় ব্যাপার জীবনে এই একটিবার দেখিয়াছি।
পরক্ষণেই বিলাসী চিৎকার করিয়া ছুটিয়া গিয়া আঁচল দিয়া তাহার হাতটা বাঁধিয়া
ফেলিল এবং যত রকমের শিকড়-বাকড় সে সঙ্গে আনিয়াছিল সমস্তই তাহাকে চিবাইতে দিল।
মৃত্যুঞ্জয়ের নিজের মাদুলি তো ছিলই, তাহার উপরে আমার মাদুলিটাও
খুলিয়া তাহার হাতে বাঁধিয়া দিলাম। আশা, বিষ ইহার ঊর্ধ্বে আর উঠিবে না, বরং সেই ‘বিষহরির আজ্ঞা’ মন্ত্রটা সতেজে বারংবার আবৃত্তি করিতে লাগিলাম। চতুর্দিকে ভিড় জমিয়া গেল এবং
এ অঞ্চলের মধ্যে যেখানে যত গুণী ব্যক্তি আছেন সকলকে খবর দিবার জন্য দিকে দিকে লোক
ছুটিল।
বিলাসীর বাপকে সংবাদ দিবার জন্য লোক গেল।
আমার মন্ত্র পড়ার আর বিরাম নাই, কিন্তু ঠিক সুবিধা হইতেছে বলিয়া
মনে হইল না। তথাপি আবৃত্তি সমভাবেই চলিতে লাগিল। কিন্তু মিনিট পনের কুড়ি পরেই যখন
মৃত্যুঞ্জয় একবার বমি করিয়া দিল, তখন বিলাসী মাটির ওপর একবারে আছাড় খাইয়া পড়িল। আমিও বুঝিলাম, বিষহরির
দোহাই বুঝি-বা আর খাটে না।
নিকটবর্তী আরও দুই-চারিজন ওস্তাদ আসিয়া পড়িলেন এবং আমরা কখনও-বা একসঙ্গে
কখনও আলাদা তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর দোহাই পাড়িতে লাগিলাম। কিন্তু বিষ দোহাই মানিল
না,
রোগীর অবস্থা μমেই
মন্দ হইতে লাগিল। যখন দেখা গেল ভালো কথায় হইবে না, তখন
তিন-চারজন ওঝা মিলিয়া বিষকে এমনি অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ করিতে লাগিল যে, বিষের কান থাকিলে সে মৃত্যুঞ্জয় তো মৃত্যুঞ্জয়, সেদিন
দেশ ছাড়িয়া পলাইত। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। আরও আধ ঘণ্টা ধ্বস্তাধ্বস্তির পরে
রোগী তাহার বাপ মায়ের দেওয়া মৃত্যুঞ্জয় নাম, তাহার শ্বশুরের দেওয়া মন্ত্রৌষধি সমস্ত মিথ্যা প্রতিপন্ন করিয়া ইহলোকের লীলা
সাঙ্গ করিল।
বিলাসী তাহার স্বামীর মাথাটা কোলে করিয়া বসিয়াছিল সে যেন একেবারে পাথর হইয়া
গেল। যাক, তাহার দুঃখের কাহিনিটি আর বাড়াইব না। কেবল এইটুকু
বলিয়া শেষ করিব যে, সে সাত দিনের বেশি বাঁচিয়া
থাকাটা সহিতে পারিল না। আমাকে শুধু একদিন বলিয়াছিল, ঠাকুর
আমার মাথার দিব্যি রইল, এসব তুমি আর কখনও করো না।
আমার মাদুলি-কবচ তো মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে কবরে গিয়াছিল, ছিল শুধু বিষহরির আজ্ঞা। কিন্তু সে আজ্ঞা যে ম্যাজিস্ট্রেটের
আজ্ঞা নহে এবং সাপের বিষ যে বাঙালির বিষ নয়, তাহা
আমিও বুঝিয়াছিলাম।
একদিন গিয়া শুনিলাম, ঘরে তো আর বিষের অভাব ছিল না, বিলাসী আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছে এবং শাস্ত্রমতে সে নিশ্চয় নরকে গিয়াছে।
কিন্তু যেখানেই যাক, আমার নিজের যখন যাইবার সময় আসিবে, তখন ওইরূপ কোনো একটা নরকে যাওয়ার প্রস্তাবে পিছাইয়া দাঁড়াইব না, এইমাত্র বলিতে পারি।
খুড়া মশাই ষোল আনা বাগান দখল করিয়া অত্যন্ত বিজ্ঞের মতো চারিদিকে বলিয়া
বেড়াইতে লাগিলেন, ওর যদি না অপঘাত-মৃত্যু হবে, তো হবে কার? পুরুষমানুষ অমন একটা ছেড়ে দশটা
করুক না, তাতে তো তেমন আসে যায়
না-না হয় একটু নিন্দাই হতো। কিন্তু হাতে ভাত খেয়ে মরতে গেলি কেন? নিজে মরলো, আমার পর্যন্ত মাথা হেঁট করে গেল।
না পেলে এক ফোঁটা আগুন, না পেলে একটা পিণ্ডি, না হলো একটা ভুজ্যি উচ্ছুগ্যু।
গ্রামের লোক একবাক্যে বলিতে লাগিল, তাহাতে আর সন্দেহ কী! অন্নপাপ। বাপ রে! এর
কি আর প্রায়শ্চিত্ত আছে।
বিলাসীর আত্মহত্যার ব্যাপারটা অনেকের কাছে পরিহাসের বিষয় হইল। আমি প্রায় ভাবি, এ অপরাধ হয়ত ইহারা উভয়েই
করিয়াছিল, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় তো পল্লিগ্রামেরই ছেলে, পাড়াগাঁয়ের তেলে-জলেই তো মানুষ। তবু অত বড় দুঃসাহসের
কাজে প্রবৃত্ত করিয়াছিল তাহাকে যে বস্তুটা সেটা কেহ একবার চোখ মেলিয়া দেখিতে পাইল
না?
আমার মনে হয়, যে দেশের নরনারীর মধ্যে পরস্পরের
হৃদয় জয় করিয়া বিবাহ করিবার রীতি নাই, বরঞ্চ তাহা নিন্দার সামগ্রী, যে দেশে নরনারী আশা করিবার সৌভাগ্য, আকাঙক্ষা করিবার ভয়ংকর আনন্দ হইতে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত, যাহাদের
জয়ের গর্ব, পরাজয়ের ব্যথা কোনোটাই জীবনে একটিবারও বহন করিতে হয়
না,
যাহাদের ভুল করিবার দুঃখ, আর
ভুল না করিবার আত্মপ্রসাদ, কিছুরই বালাই নাই, যাহাদের প্রাচীন এবং বহুদর্শী বিজ্ঞ সমাজ সর্ব প্রকারের হাঙ্গামা হইতে
অত্যন্ত সাবধানে দেশের লোককে তফাৎ করিয়া, আজীবন কেবল ভালোটি হইয়া থাকিবারই ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, তাই বিবাহ ব্যাপারটা যাহাদের শুধু নিছক Contract তা সে যতই কেননা বৈদিক
মন্ত্র দিয়া Document পাকা করা হোক, সে দেশের লোকের সাধ্যই নাই
মৃত্যুঞ্জয়ের অন্নপাপের কারণ বোঝে। বিলাসীকে
যাঁহারা পরিহাস করিয়াছিলেন, তাঁহারা সাধু গৃহস্থ এবং সাধ্বী
গৃহিণী- অক্ষয় সতীলোক তাঁহারা সবাই পাইবেন, তাও
আমি জানি কিন্তু সেই সাপুড়ের মেয়েটি যখন একটি পীড়িত শয্যাগত লোককে তিল তিল করিয়া
জয় করিতেছিল, তাহার তখনকার সেই গৌরবের
কণামাত্র হয়ত আজিও ইহাদের কেহ চোখে দেখেন নাই। মৃত্যুঞ্জয় হয়ত নিতান্তই একটা তুচ্ছ
মানুষ ছিল, কিন্তু তাহার হৃদয় জয় করিয়া দখল করার আনন্দটাও
তুচ্ছ নয়, সে সম্পদও অকিঞ্চিৎকর নহে।
এই বস্তুটাই এ দেশের লোকের পক্ষে বুঝিয়া উঠা কঠিন। আমি ভূদেববাবুর পারিবারিক
প্রবন্ধেরও দোষ দিব না এবং শাস্ত্রীয় তথা সামাজিক বিধি-ব্যবস্থারও নিন্দা করিব না।
করিলেও মুখের ওপর কড়া জবাব দিয়া যাঁহারা বলিবেন, এই হিন্দু সমাজ তাহার নির্ভুল বিধিব্যবস্থার জোরেই অত শতাব্দীর অতগুলো
বিপ্লবের মধ্যে বাঁচিয়া আছে, আমি তাঁহাদেরও অতিশয় ভক্তি করি, প্রত্যুত্তরে আমি কখনই বলিব না, টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা নয়, এবং অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে। আমি শুধু এই বলিব
যে,
বড়লোকের নন্দগোপালটির মতো দিবারাত্রি চোখে চোখে এবং
কোলে কোলে রাখিলে যে সে বেশটি থাকিবে, তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই, কিন্তু একেবারে তেলাপোকাটির মত বাঁচাইয়া রাখার চেয়ে এক আধবার কোল হইতে
নামাইয়া আরও পাঁচজন মানুষের মতো দু-এক পা হাঁটিতে দিলেই প্রায়শ্চিত্ত করার মত পাপ
হয় না।
শব্দার্থ ও টীকা
💙 মা-সরস্বতী - হিন্দু পুরাণ অনুসারে
বিদ্যা ও কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
👉 বীণাপাণি। বাগ্দবী।
👉 কৃতবিদ্য - বিদ্যা অর্জন করেছেন এমন পণ্ডিত। বিদ্বান।
👉 বঁইচি - কাঁটাযুক্ত একরকম ছোট গাছ ও তার ফল।
👉 রম্ভার কাঁদি - কলার ছড়া।
👉 কানাচ - ঘরের পেছন দিককার লাগোয়া জায়গা।
👉 খেজুরমেতি - খেজুর গাছের মাথার কাছের নরম
মিষ্টি অংশ।
👉 কামস্কাট্কা - প্রকৃত উচ্চারণ কামচাট্কা (Kamchatka) রাশিয়ার অন্তর্গত সাইবেরিয়ার উত্তর পূর্বে অবস্থিত একটি উপদ্বীপ। এর
দক্ষিণ-পশ্চিমে ওখটক সাগর ও উত্তর-পূর্বে বেরিং সাগর। উপদ্বীপটি পার্বত্য, তুন্দ্রা ও বনময়। বহু উষ্ণ প্রস্রবণ ও সতেরোটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে এখানে।
প্রচুর স্যামন মাছ পাওয়া যায় বলে দ্বীপটি স্যামন মাছের দেশ নামে পরিচিত। রাজধানী
শহরের নাম- পেত্রোপাভ্লোভস্ক্।
👉 সাইবেরিয়া - এশিয়ার উত্তরে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত
এশিয়ার উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূভাগ। এশিয়া মহাদেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল এর মধ্যে
পড়েছে। তুন্দ্রা, সরলবর্গীয় বৃক্ষের অরণ্য, স্তেপ তৃণভূমি ও পৃথিবীর গভীরতম হ্রদ ‘বৈকাল’ এখানে অবস্থিত। পৃথিবীর দীর্ঘতম রেলপথ ট্রান্স-সাইবেরিয়ান চালু হওয়ার পর
এখানে বহু শহর গড়ে উঠেছে।
👉 এডেন - লোহিতসাগর ও আরব সাগরের প্রবেশপথে আরব
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বিখ্যাত বন্দর। সামুদ্রিক লবণ তৈরির জন্য বিখ্যাত।
👉 পারশিয়া - পারস্য বা ইরান দেশ।
👉 হুমায়ূন - মোগল সাম্ররাজ্যের
প্রতিষ্ঠাতা বাবরের পুত্র এবং দ্বিতীয় মোগল সম্রাট। তিনি মোগল সম্রাট আকবরের পিতা।
👉 তোগলক খাঁ - ভারতবর্ষের ইতিহাসে তোগলক খাঁ নামে
কোনো সম্রাট ছিলেন না। ইতিহাসে যে তিনজন বিখ্যাত তোগলক সসম্রাটের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন : গিয়াসউদ্দিন তোগলক, মুহাম্মদ তোগলক ও ফিরোজ তোগলক।
👉 চল্লিশের কোঠা - এখানে চল্লিশ থেকে ঊনপঞ্চাশ
পর্যন্ত বয়সসীমা।
👉 থার্ড ক্লাস - বর্তমান অষ্টম শ্রেণি। সেকালে
মাধ্যমিক শিক্ষার শ্রেণি হিসাব করা হতো ওপর থেকে নিচের দিকে। দশম শ্রেণি তখন ছিল
ফার্স্ট ক্লাস, নবম শ্রেণি ছিল সেকেন্ড ক্লাস।
👉 প্রত্নতাত্ত্বিক - পুরাতত্ত্ববিদ। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, মুদ্রা, লিপি ইত্যাদি থেকে ঐতিহাসিক তথ্য নির্ণয়ের বিদ্যায় পণ্ডিত ব্যক্তি।
👉 ফোর্থ ক্লাস - এখনকার সপ্তম শ্রেণি।
👉 সেকেন্ড ক্লাস - এখনকার নবম শ্রেণি।
👉 গুলি - আফিমের তৈরি একরকম মাদক যা বড়ির মতো
গুলি পাকিয়ে ব্যবহার করা হয়।
👉 ওপরের আদালতের হুকুমে - স্রষ্টার নির্দেশে।
👉 এমনি সুনাম - দুর্নাম বোঝাতে বিদ্রুপ করা
হয়েছে।
👉 মালো - এ গল্পে সাপের ওঝা অর্থে ব্যবহৃত।
সাধারণত এরা সাপ ধরে, সাপের কামড়ের চিকিৎসা ও সাপের
খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে মালো বলতে এমন একটি সম্প্রদায়কেও বোঝায় যাদের
পেশা মাছ ধরা।
👉 সদ্ব্যয় করিয়াছি - অপব্যয় করেছি বোঝাতে ব্যঙ্গ
ভরে বলা হয়েছে।
👉 কঙ্কালসার - অস্থিচর্মসার অবস্থা যেন প্রায়
কঙ্কাল।
👉 যমরাজ - ধর্মরাজ। এখানে মৃত্যু অর্থে।
👉 তিলার্ধ - তিল পরিমাণ সময়ের অর্ধ, মুহূর্তমাত্র।
👉 জনশ্রুতি - লোকপরম্পরায় শোনা কথা, জনরব, লোকশ্রুতি।
👉 সত্যযুগ - হিন্দু পুরাণে বর্ণিত চার যুগের
প্রথম যুগ যখন সমাজে অসত্য অন্যায় একেবারেই ছিল না বলে ধারণা করা হয়।
👉 রসাতলে গেল - অধঃপাতে বা উচ্ছনেড়ব গেল।
👉 অকালকুষ্মা- - অসময়ে ফলেছে এমন কুমড়ো। এখানে
অকর্মণ্য ব্যক্তি।
👉 নিকা - আরবি শব্দ নিকাহ্; বিয়ে। বিধবাবিবাহ বা পুনর্বার বিবাহ।
👉 কলি - হিন্দু পুরাণে বর্ণিত চার যুগের শেষ যুগ।
পুরাণ মতে, এ যুগে অন্যায়, অসত্য
ও অধর্মের বাড়াবাড়ি ঘটবে।
👉 বদন দগ্ধ না হয় - মুখ যেন না পোড়ে। সুনাম যেন
নষ্ট না হয়।
👉 নারায়ণের কর্তৃপক্ষেরও চক্ষুলজ্জা হইবে -
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একদিকে সর্বভারতীয় রাজারা একপক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন নিরস্ত্র রথ-সারথি। সেখানে নারায়ণের নিরপেক্ষ আচরণ ছিল
কাপুরুষ-সুলভ। সেই নারায়ণের পথাবলম্বীরাও এরূপ আচরণকে ভীরুতা বলতে লজ্জিত হবে।
বাক্যাংশটিতে প্রকৃতপক্ষে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে যে- ওদের
আচরণ এতই বর্বর ছিল যে তা কাপুরুষতার চেয়েও লজ্জাজনক ছিল।
👉 বিলাত প্রভৃতি ম্লেচ্ছদেশে - ইংল্যান্ডসহ
ইউরোপীয় দেশসমূহে যেখানে হিন্দু সমাজের আচারধর্মের কোনো বালাই নেই।
👉 সনাতন হিন্দু এ কুসংস্কার মানে না - এখানে
হিন্দু ধর্মের সংস্কারাচ্ছন্নতাকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
👉 শ্রাব্য-অশ্রাব্য - শোনার যোগ্য ও অযোগ্য।
শ্লীল-অশ্লীল অর্থে ব্যবহৃত।
👉 দেবী বীণাপাণির বরে সংকীর্ণতা তাহাদের মধ্যে
আসিবে কী করিয়া - এখানে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে- দেবী সরস্বতীর প্রকৃত মান্যতার
অভাবে এরা সংকীর্ণতাসর্বস্ব হয়ে পড়েছে।
👉 প্রাতঃস্মরণীয় - প্রাতঃকালে স্মরণ করার যোগ্য।
অতি শ্রদ্ধেয়।
👉 সেটা কাশীই বটে - কাশী ভারতের উত্তর প্রদেশে
অবস্থিত বিখ্যাত ও সুপ্রাচীন তীর্থক্ষেত্র। সেখানে সাধু-সন্ত-পুণ্যার্থীর সমাবেশ
যেমন হয় তেমনি দুশ্চরিত্র লোকজনের আখড়াও সেখানে জমে। মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বিধবা
পুত্রবধূকে যেখান থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছিল তা কাশী হলেও তীর্থস্থান ছিল না বরং
পতিতালয় বা অনুরূপ কোনো স্থান ছিল এখানে সেই ইঙ্গিতই করা হয়েছে।
👉 বারওয়ারি - অনেকের সমবেত চেষ্টায় যা করা হয়।
সর্বজনীন। বারোয়ারি।
👉 সুদক্ষিণা - পুরোহিতের সম্মানী বা সেলামি।
👉 ফলাহার - জলযোগ। ফলার।
👉 ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল - সকলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ
হয়ে উঠলেন।
👉 মহত্ত্বের কাহিনি - মহানুভবতার কথা।
ব্যঙ্গার্থে নীচতার কাহিনি।
👉 এন্ট্রান্স - প্রবেশিকা পরীক্ষা। বর্তমান
মাধ্যমিক পরীক্ষার সমতুল্য।
👉 ধুচুনি - চাল ইত্যাদি ধোয়ার জন্য বহু
ছিদ্রবিশিষ্ট বাঁশের ঝুড়ি।
👉 পঞ্চমুখ - পাঁচ মুখে যে কথা বলে। মুখর।
👉 পল্লিগ্রামের পুরুষদের সুখ্যাতিতে - ব্যঙ্গ করে
সুখ্যাতি বলা হয়েছে। বস্তুত লেখক গ্রামের পুরুষদের সমালোচনা ও নিন্দা করেছেন।
👉 মন্ত্রসিদ্ধ - মন্ত্রে সাধনায় সিদ্ধি অর্জন
করেছেন এমন যার উচ্চারিত মন্ত্র অব্যর্থভাবে কার্যকর।
👉 মনসা - হিন্দু ধর্মানুসারে সাপের দেবী।
👉 মন্ত্রের দ্রষ্টা - যিনি প্রথম মন্ত্র লাভ
করেন। মন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ লোকবিশ্বাস এই যে, মন্ত্র
কেউ তৈরি করেন না। তা কোনো ভাগ্যবান দৈববলে পেয়ে থাকেন। যাঁর কাছে প্রথম মন্ত্র
আবির্ভূত হয় তিনিই মন্ত্রদ্রষ্টা।
👉 কামাখ্যা - ভারতের আসাম রাজ্যে অবস্থিত প্রাচীন
তীর্থস্থান। তান্ত্রিক সাধক ও উপাসকদের তন্ত্রমন্ত্র সাধনার জন্য বিখ্যাত।
👉 চক্র তুলিয়া - ফণা তুলে।
👉 খরিশ গোখরা - খুব বিষাক্ত এক প্রজাতির গোখরা
সাপ।
👉 বিষহরির দোহাই - মনসার মন্ত্রশক্তি।
👉 মৃত্যুঞ্জয় নাম - মৃত্যুঞ্জয় নামের অর্থ- যিনি
মৃত্যুকে জয় করেন। বিষকণ্ঠ শিব বা মহেশ্বরের অন্য নাম মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুঞ্জয়ের
বাবা-মা তাদের পুত্রের নাম মৃত্যুঞ্জয় রাখলেও সে মৃত্যুকে জয় করতে পারল না। তার
নাম মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো।
👉 শ্বশুরের দেওয়া মন্ত্রৌষধি - মৃত্যুঞ্জয় তার
শ্বশুরের কাছ থেকে অমোঘ মন্ত্রৌষধি পেয়েছিল বলে জনশ্রুতি ছিল।
👉 ম্যাজিস্ট্রেটের আজ্ঞা - জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের
আদেশ বা হুকুম যা পালন করা বাধ্যতামূলক। ম্যাজিস্ট্রেট চলে গেলেও হুকুম বহাল থাকে।
👉 বাঙালির বিষ - লেখক ব্যঙ্গার্থে বলতে চান, বাঙালির μোধ, বিদ্বেষ
ইত্যাদি মুখের বাক্যেই সীমাবদ্ধ এবং ক্ষণস্থায়ী। তা সাপের বিষের মতো অব্যর্থভাবে
কার্যকর নয়।
👉 পিণ্ডি
শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে মৃতের উদ্দেশে দেওয়া চালের গোলাকার ডেলা।
👉 ভুজ্যি উচ্ছুগ্য - মৃতের আত্মার সদগতি কামনা
করে ব্রাহ্মণকে যে ভোজ্য উৎসর্গ করা হয় তা।
👉 বহুদর্শী - জ্ঞানী। অনেক দেখেছেন এমন। বহু
অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
👉 ভূদেববাবু - ভূদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
(১৮২৫-১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দ) উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। হিন্দু
সমাজের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মত ব্যক্ত করে আধুনিক মানস গঠনের লক্ষ্যে তিনি
অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’, ‘সামাজিক প্রবন্ধ’, ‘আচার প্রবন্ধ’ ইত্যাদি এ বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।
👉 অতিকায় হস্তী - মহাগজ। গধসসড়ঃয। হাতির এই
প্রজাতি বর্তমান কালের হাতির চেয়ে অনেক বড় ছিল। এই প্রজাতির হাতি প্রাণিজগৎ থেকে
লুপ্ত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে। তাদের অস্তিত্বের চিহ্ন রয়ে গেছে তাদের কঙ্কালে।
পাঠ-পরিচিতি
শরৎচন্দ্রের “বিলাসী” গল্পটি প্রথমে প্রকাশিত হয় ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৩২৫ বঙ্গাব্দের (১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ) বৈশাখ সংখ্যায়। “ন্যাড়া” নামের এক যুবকের নিজের জবানিতে বিবৃত হয়েছে এ গল্প। এই গল্পের কাহিনিতে
শরৎচন্দ্রের প্রথম জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে। “বিলাসী” গল্পে বর্ণিত হয়েছে ব্যতিμমধর্মী
দুই মানব-মানবীর চরিত্রের অসাধারণ প্রেমের মহিমা, যা
ছাপিয়ে উঠেছে জাতিগত বিভেদের সংকীর্ণ
সীমা। গল্পে সংঘটিত একের পর এক ঘটনা এবং বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে সংঘাতের মাধ্যমেই
কাহিনি অগ্রসর হয়। ঘটনার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে কাহিনিতে গতি সঞ্চারিত হয়েছে। লেখক কোন অবস্থান থেকে কাহিনি বলছেন, সেটা
অনেক সময় কাহিনি বর্ণনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লেখক সর্বদর্শী অবস্থান থেকেও কাহিনি বর্ণনা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি
সবগুলো চরিত্র ও ঘটনা- নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বর্ণনা করেন। যেমনটি দেখা যায় সৈয়দ
ওয়ালীউল্লাহ্র ‘লালসালু’ উপন্যাস এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “মাসি-পিসি” গল্পে। পক্ষান্তরে গল্পটি উত্তম পুরুষের ভাষ্যেও বর্ণিত হতে পারে। এক্ষেত্রে
গল্পে আমি, আমাকে ইত্যাদি সর্বনাম এসে যায়। এরকম ক্ষেত্রে
কখনো-কখনো লেখক নিজেই কাহিনির একটা চরিত্রের ভূমিকা নেন, হয়ে ওঠেন কথক। “বিলাসী” গল্পে লেখক সেই ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।
বর্তমান সংকলনের “অপরিচিতা”, “আহ্বান” ও “তাজমহল” গল্পে উত্তমপুরুষের ভাষ্য গৃহীত হয়েছে।
“বিলাসী” গল্পের নাম চরিত্র কর্মনিপুণ, বুদ্ধিমতী ও সেবাব্রতী বিলাসী; শরৎসাহিত্যের অন্যান্য উজ্জ্বল
নায়িকাদের মতোই একজন। যে প্রেমের জন্যে নির্দ্বিধায় বেছে নিয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুর
পথ আর তার প্রেমের মহিমাময় আলোয় ধরা পড়েছে সমাজের অনুদারতা ও রক্ষণশীলতা, জীবনের নিষ্ঠুর ও অশুভ চেহারা।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. “ঘন জঙ্গলের পথ। একটু দেখে পা ফেলে যেয়ো।”- উক্তিটি কার?
ক. ন্যাড়ার খ. মৃত্যুঞ্জয়ের গ. বিলাসীর ঘ.
খুড়ার
২. ‘মহত্ত্বের কাহিনি আমাদের অনেক আছে’। এখানে ‘মহত্ত্ব’ কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে?
ক. ব্যঙ্গার্থে খ.
প্রশংসার্থে গ. ক্ষোভার্থে ঘ. নিন্দার্থে
বিগতসালের প্রশ্নোত্তর:
০১. ‘চার ক্রোশ পথ ভেঙ্গে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়।’-এক ক্রোশে কত মাইল?
[গুচ্ছভুক্ত ‘ক’ ২০২২-২৩].
উত্তর- ২.৫ মাইল।
০২. মৃত্যুঞ্জয়ের পর বিলাসী কত দিন বেঁচে ছিল?
উত্তর- সপ্তাহখানেক [জাহা: বিশ্ব: ‘C' শিফট ৫ ২০২২-২৩].
০৩. ’ঠিক যেন ফুলদানিতে জল দিয়া ভিজাইয়া রাখা বাসি ফুলের মতো। হাত দিয়া এতাটুকু স্পর্শ করিলে, এতোটুকু নাড়াচাড়া করিতে গেলেই ঝরিয়া পড়িবে।’ উক্তিটি কোন গল্পে আছে?
[ঢাবি “ঘ” ২০০১-২০০২].
উত্তর: বিলাসী।
০৪. ‘বিলাসী’ গল্পে গোয়ালার বাড়ি কত দূরে ছিল? [ববি “খ” ২০১৫-২০১৬].
উত্তর: দেড় ক্রোশ।
০৫.
গৃহ [রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন].
লেখক-পরিচিতি: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত
পায়রাবন্দ গ্রামে জনুগ্ঘহণ করেন । তার পিতার নাম জহিরউদ্দীন আবু আলী
হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা চৌধুরী । তার প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন এবং
বৈবাহিক সূত্রে নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রোকেয়ার পিতা বহু ভাষায় সুপন্তিত
হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল । বড়ভাই-বোনের সাহচর্যে রোকেয়া
বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ভালোভাবেই রপ্ত করেন এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে
উঠেন। ১৮৯৮ সালে উ্দু্ভাষী ও বিপত্বীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তিনি বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তার
জ্ঞানার্জনের পথ অধিকতর সুগম হয় । বিরূপ সমালোচনা ও নানাবিধ
প্রতিবন্ধকতার মুখেও তিনি কখনই নারীশিক্ষার লক্ষ্য থেকে সরে আসেন নি; বরং পর্দাপ্রথা ও শিক্ষাবিমুখ মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত
করার জন্য বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। রোকেয়া বাংলা গদ্যের
বিশিষ্ট শিল্পী। সমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার জন্য তিনি অসাধারণ
পান্তিত্যপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী গদ্য রচনা করেন। তাঁর সব রচনাই সমাজ জীবনের গভীর উপলব্ধি
থেকে উৎসারিত । 'মতিচুর' ও “অবরোধবাসিনী" তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ
গদ্যরন্থ। এছাড়া সুলতানার
স্বপ্ন ও 'পদ্মরাগ'
নামে দুটি উপন্যাসও তিনি রচনা করেন।১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে ।
গৃহ বলিলে একটা
আরাম বিরামের শান্তি-নিকেতন বুঝায়- যেখানে দিবাশেষে গৃহী কর্মাত্ত শ্রান্ত
অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়া বিশ্রাম করিতে পারে । গৃহ গৃহীকে রৌদ্র বৃষ্টি হিম হইতে
রক্ষা করে। পশু পক্ষীদেরও গৃহ আছে। তাহারাও স্ব স্ব গৃহে আপনাকে নিরাপদ মনে করে । পিপাসা না থাকিলে জল যেমন উপাদেয় বোধ হয় না, সম্ভবত সেইরূপ গৃহ ছাড়িয়া কতকদিন
বিদেশে না থাকিলে গৃহসুখ মিষ্টি বোধ হয় না। পুরুষেরা যদিও সর্বদা বিদেশে
যায় না, তবু সমস্ত দিন বাহিরে সংসারক্ষেত্রে থাকিয়া
অপরাহ্ছে গৃহে ফিরিয়া আসিবার জন্য উৎসুক হয়- বাড়ি আসিলে
যেন হাফ ছাড়িয়া বাচে। এখন আমাদের গৃহ সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলিতে চাই । আমাদের
সামাজিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখি, অধিকাংশ
ভারত নারী গৃহসুখে বঞ্চিতা । যাহারা অপরের অধীনে থাকে, অভিভাবকদের
বাটাকে আপন ভবন মনে করিতে যাহাদের অধিকার নাই, গৃহ
তাহাদের নিকট কারাগার তুল্য বোধ হয়। পারিবারিক জীবনে যে সুখী নহে, সে নিজেকে পরিবারের একজন গণ্য বলিয়া মনে করিতে
সাহসী নহে, তাহার নিকট গৃহ শান্তিনিকেতন বোধ হইতে পারে না
। কুমারী, সধবা, বিধবা- সকল শ্রেণির অবলার অবস্থাই শোচনীয় । প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটি অন্তঃপুরের
একটু একটু নমুনা দিতেছি। এরূপে অন্তঃপুরের পর্দা উঠাইয়া
ভিতরের দৃশ্য দেখাইলে আমার ভ্রাতৃগণ অত্যন্ত ব্যথিত হইবেন, সন্দেহ নাই। আমরা একবার (বেহারে) জামালপুরের নিকটবর্তী কোন শহরে বেড়াইতে গিয়াছিলাম।
সেখানে আমাদের জনৈক বন্ধুর বাড়ি আছে। সে বাটীর পুরুষের সহিত আমাদের আত্তীয় পুরুষদের
বন্ধুত আছে বলিয়া শরাফত মিষ্টভাষিণী, যদিও কুপমণ্ডুক! তাহারা আমাদের যথোচিত অভ্যর্থনা করিলেন । সেখানে
শরাফতের পত্রী হসিনা, ভগ্মী জমিলা, জমিলার কন্যা ও পুত্রবধূ প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর জমিলাকে যখন
আমাদের বাসায় যাইতে অনুরোধ করিলাম, তখন তিনি বলিলেন যে
তাহারা কোন কালে বাড়ির বাহির হন না, ইহাই তাহাদের
বংশগৌরব ৷ কখনও ঘোড়ার গাড়ি বা অন্য কোন যানবাহনে আরোহণ করেন নাই । আমি সবিস্ময়ে বলিলাম, “তবে আপনারা বিবাহ করিয়া শ্বশুরবাড়ি যান কিরূপে? আপনার ভ্রাত্বধূ আসিলেন কি করিয়া?” জমিলা
উত্তর দিলেন, “ইনি আমাদের আত্রীয়-কন্যা- এ পাড়ায় কেবল
আমাদেরই গোষ্ঠীর বাড়ি পাশাপাশি দেখিবে ।” এই বলিয়া তিনি আমাকে অন্য একটা ঘরে লইয়া গিয়া বলিলেন, “এই আমার কন্যার বাড়ি; এখন আমার বাড়ি চল ।” তিনি আমাকে একটা
অপ্রশস্ত গলির ভিতর দিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া লইয়া গেলেন। তাহার সকলগুলি কক্ষ
দেখাইলেন। কক্ষগুলি “অসূ্যম্পশ্য”
বলিয়া বোধ হইল। অতঃপর একটি দ্বার খুলিলে
দেখিলাম অপরদিকে হসিনার পুত্রবধূ আছে! - জমিলা বলিলেন, “দেখিলে
এই ছ্বারের ওপারে আমার ভাইয়ের বাড়ি, এপার্ষে আমার বাড়ি
। ও কক্ষে বধূ থাকেন বলিয়া এ দ্বারটি বন্ধ রাখি। আমাদের সওয়ারির দরকার হয় না
কেন, তাহা এখন বুঝিলে?” এঁরূপে
সকল বাড়িই প্রদক্ষিণ করা যায়।
পাঠিকা কি মনে করেন যে হসিনা বা জমিলা গৃহে আছেন? অবশ্য নাঃ কেবল চারি প্রাটারের
ভিতর থাকিলেই গৃহে থাকা হয় না। এদেশে বাসরঘরকে “'কোহ্বর”
বলে, কিন্ত “কবর”
বলা উচিত!! বাড়িখানা ত শরাফতের, সেখানে
যেমন এক পাল ছাগল আছে, হংস কুকুট আছে, সেইরূপ একদল স্ত্রীলোকও আছেন! অথবা স্ত্রীলোকদের “বন্দিনী” বলা
যাইতে পারে! সাধারণত পরিবারের প্রধান পুরুষটি মনে করেন গৃহখানা কেবল “আমার বাটী”- পরিবারস্থ অন্যান্য লোকেরা তাহার আশ্রিতা। মালদহে কয়েকবার আমরা এক
বাটাতে যাতায়াত করিয়াছি।
গৃহস্বামী কলিমের স্ত্রীকে আমরা কখনও প্রফুল্লুমুখী দেখি নাই । তীহার স্লান
মুখখানি নীরবে আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি আকর্ষণ করিত । ইহার কারণ এই- কয় বৎসর অতীত হইল, কলিম স্বীয় ভায়রা ভাইয়ের সহিত
বিবাদ করিয়াছেন; তাহার ফলে
কলিমের পত্রী স্বীয় ভন্মীর সহিত দেখা করিতে পান না! তিনি
এতটুকু ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া বলিতে পারেন না, “আমার ভগ্নী আমার নিকট অবশ্য আসিবেন।”
হায়! বাটী যে কলিমের! তিনি যাহাকে ইচ্ছা
আসিতে দিবেন, যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন না! আবার ওদিকে ও
বাটীখানা সলিমের! সেখানে কলিমের পত্বীর প্রবেশ নিষেধ! বলা বাহুল্য কলিমের স্ত্রীর অন্ন,
বস্ত্র বা অলংকারের অভাব নাই। বলি, অলংকার
কি পিতৃমাতৃহীনা অবলার একমাত্র ভগ্নীর বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা ভুলাইতে পারে? শুনিলাম, তিনি সপত্নী-কণ্টক
হইতেও বিমুক্ত নহে! এরূপ অবস্থায় তাহার নিকট গৃহ কি
শান্তিনিকেতন বলিয়া বোধ হয়? আমরা রমাসুন্দরীকে অনেকদিন হইতে জানি ।
তিনি বিধবা; সন্তান
সন্ততিও নাই। তীহার স্বামীর প্রভূত সম্পত্তি আছে, দুই
চারিটি পাকা বাড়িও আছে। তাহার দেবর এখন সে সকল সম্পত্তির
অধীশ্বর। দেবরটি কিন্তু রমাকে একমুঠা অন্ন এবং আশ্রয়দানেও কুষ্ঠিত। আমরা বলিলাম,
“ইনি হয়ত দেবর-পত্রীর সহিত কৌদল করেন ।”
এ কথার উত্তরে একজন বলিলেন, “রমা সব
করিতে জানে, কেবল কৌদল জানে না। রমা বেশ জানে, কি করিয়া পরকে আপন করিতে হয়; কেবল আপনাকে পর
করিতে জানে না।”“এত গুণ সন্টেও দেবরের বাড়ি থাকিতে
পান না কেন?” “কপালের দোষ!”আমরা একটি রাজবাড়ি দেখিতে গিয়াছিলাম।
বাড়িখানি কবি-বর্ণিত অমরাবতীর ন্যায় মনোহর । বৈঠকখানা বিবিধ মূল্যবান সাজসজ্জায়
ঝলমল করিতেছে; এদিকে
সেদিকে ৫/৭ খানা রজত-আসন শূন্য হৃদয়ে রাজাকে আহ্বান করিতেছে!
রাণীর ঘর কয়খানাতেও টেবিল, টিপাই, চেয়ার ইত্যাদি
সাজসঙ্জা আছে। কিন্তু তাহার উপর ধুলার স্তর পড়িয়াছে। রাজা
কোন কালে এসব কক্ষে পদার্পণ করেন বলিয়া বোধ হইল না। রাণীকে দেখিয়া আমি হতাশ হইলাম । কারণ বৈঠকখানা দেখিয়া আমি রাণীর যেরপ মূর্তি কল্পনা
করিয়াছিলাম, এ মূর্তি তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি পরমা
সুন্দরী বালিকা- পরিধানে সামান্য লালপেড়ে বিলাতি ধুতি; মাথায় রুক্ষ কেশের জটা- অনুমান পনের দিন হইতে তৈলের সহিত চুলগুলির সাক্ষাৎ হয় নাই, মুখখানি এমনই করুণ ভাবে পূর্ণ যে রাণীকে
মূর্তিমতী “বিষাদ” বলিলে
অত্যুক্তি হয় না। অনেকের মতে চক্ষু মনের দর্পণ স্বরূপ ।
রাণীর নয়ন দুটিতে কি কি হৃদয়বিদারক
ভাব ছিল, তাহা আমি বর্ণনা করিতে অক্ষম । আমাদের একটি বর্ষীয়সী সঙ্গিনী বলিলেন, ““তুমি রাজার রাণী, তোমার এ বেশ কেন? এস আমি চুল বেঁধে দিই।”
রাণী উত্তর দিলেন, “জানি না কি পাপে
রাণী হয়েছি!” ঠিক কথা! অথচ লোকে এই রাণীর পদ কেমন
বাঞ্ছনীয় বোধ করে!“মহম্মাদীয় আইন” অনুসারে
আমরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হই- “আমাদের বাড়ি”ও হয়। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়, - বাড়ির প্রকৃত কর্তা স্বামী, পুত্র, জামাতা, দেবর
ইত্যাদি হন। তাহাদের অভাবে বড় আমলা বা নায়েবটি বাড়ির মালিক! গৃহকত্রীটি এ নায়েবের ত্রীড়াপুতুল
মাত্র। নায়েব কন্রীকে যাহা বুঝায়, অবোধ নিরক্ষর কক্রী তাহাই বুঝেন । এরূপ আরও কত উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে । খদিজা প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী, তাহার স্বামী হাশেম দরিদ্র কিন্ত কুলীন বিদ্বান। হাশেম ছলে কৌশলে সমস্ত
জমিজমা আত্মসাৎ করিয়া লইলেন; খদিজার
হাতে এক পয়সা নাই। খদিজার পৈত্রিক বাড়িতে বসিয়াই হাশেম
আর দুই তিনটা বিবাহ (?) করিয়া তাহাকে সতিনী জ্বালায়
দগ্ধ করিতে লাগিলেন! এরূপ না করিলে আর ক্ষমতাশালী পুরুষের বাহাদুরি কি? ইহাতে যদি খদিজা আমার এই প্রবন্ধ পাঠ করিয়া
ভ্রাতা ভগ্নীগণ হয়ত মনে করিবেন যে আমি কেবল ভ্রাতৃবৃন্দকে নরাকারে পিশাচরূপে
অঙ্কিত করিবার জন্যই কলম ধরিয়াছি। তাহা নয়। আমি ত কোথাও
ভ্রাতাদের প্রতি কটু শব্দ ব্যবহার করি নাই- কাহাকেও পাপিষ্ঠ, পিশাচ, নিষ্ঠুর বলিয়াছি কি?
কেবল রমণীহদয়ের ক্ষত দেখাইয়াছি। এ যে কথায় বলে, “বলিতে
আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়”, এক্ষেত্রে তাহাই হইয়াছে- ভগ্মীর দুঃখ বর্ণনা করিতে ভ্রাতৃনিন্দা হইয়া পড়িয়াছে।সুখের বিষয়
আমাদের অনেক ভ্রাতা এরূপ আছেন, যাহারা স্ত্রীলোকদিগকে
যথেষ্ট শান্তিতে গৃহসুখে রাখেন । কিন্তু দুঃখের সহিত আমরা ইহাও বলিতে বাধ্য যে অনেক
ভ্রাতা আপন আপন বাটীতে অন্যায় স্বামীতের পরিচয় দিয়া থাকেন।যখন আমাদের চালের উপর খড় থাকে না,
দরিদ্রের জীর্ণ তম কুটিরের শেষ চালখানা ঝঞ্জানিলে উড়িয়া যায়, - টুপ-টাপ বৃষ্টিধারায় আমরা সমস্ত রাত্রি ভিজিতে থাকি, - চপলা-চমকে
নয়নে ধাধা লাগে, - বজ্রনাদে মেদিনী কাঁপে, এবং আমাদের বুক কীপে- প্রতি মুহূর্তে
ভাবি, বুঝি বজ্রপাতে মারা যাই-
তখনও আমরা অভিভাবকের বাটীতেই থাকি! যখন আমরা রাজকন্যা, রাজবধূরূপে প্রাসাদে থাকি, তখনও প্রভু-গৃহে
থাকি । আবার যখন এ প্রাসাদতুল্য ত্রিতল অট্টালিকা ভূমিকম্পে চূর্ণ হয়, - সোপান অতিক্রম করিয়া অবতরণ কালে আমাদের মাথা
ভাঙ্গে, হাত পা ভাঙ্গে- রক্তাক্ত কলেবরে হতজ্ঞান প্রায় অবস্থায় গোশালায় গিয়া আশ্রয় লই, - তখনও
অভিভাবকদের বাটীতে থাকি!!অথবা গৃহস্থের বৌ-ঝি রূপে প্রকাণ্ড আটচালায় বাস করিলেও প্রভুর আলয়ে থাকি;
আর যখন চৈত্র মাসে ঘোর অমানিশীথে প্রভুর বাটীতে দুষ্টরলোক কর্তৃক
লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয় হয়, -সব জিনিসপত্রসহ
ঘরগুলি দাউদাউ করিয়া জলিতে থাকে, - আমরা একবসনে প্রাণটি হাতে করিয়া কোনমতে দৌড়াইয়া গিয়া দূরস্থিত
একটা কুলগাছতলে দীড়াইয়া কাপিতে
থাকি,_ তখনও অভিভাবকের বাটীতে থাকি!!! ইংরেজিতে (Home) বলিতে যাহা বুঝায়, ““গৃহ"
শব্দ দ্বারা আমি তাহাই বুঝাইতে চাই । শারীরিক আরাম ও
মানসিক শান্তিনিকেতন যাহা, তাহাই গৃহ। বিধবা হইলে স্বামীগৃহ একরূপ
বাসের অযোগ্য হয়; হতভাগিনী তখন পিতা, ভ্রাতার শরণাপন্ন হয় । একটা হিন্দি প্রবাদ আছে:“ঘর কি
জলি বনমে গেয়ী-বনমে লাগি আগ বন বেচারা কিয়া করে,- কররমমে
লাগি আগ!” অর্থাৎ ““গৃহে দগ্ধ হইয়া বনে গেলাম, বনে লাগিল আগুন;
বন বেচারা কি করিবে, (আমার) কপালেই লাগিয়াছে আগুন |” তাই বলি, গৃহ বলিতে আমাদেরই একটি পর্ণকুটীর নাই। প্রাণি-জগতে কোন জন্তই আমাদের
মত নিরাশ্য়া নহে। সকলেরই গৃহ আছে- নাই কেবল আমাদের । (সংক্ষেপিত)
শব্দার্থ ও টীকা👉বিরাম _ বিশ্রাম👉 নিকেতন _ বাড়ি👉শান্ত _ কাজ করে ক্লান্ত।👉 গৃহী _ গৃহে বসবাসকারী ।👉 উপাদেয়_ সুস্বাদু।👉 বাটা _ বাড়ি।👉 অন্তঃপুর _ ভেতর বাড়ি।👉 মেদিনী _ পৃথিবী ।👉 ত্রিতল _ তিন তলা বিশিষ্ট ।👉 অট্টালিকা _ দালান।👉 সোপান _ সিঁড়ি।👉 কলেবর _ দেহ, শরীর।👉 গোশালা _ গোয়ালঘর।👉 অমানিশীথ _ অন্ধকার রাত্রি।👉লঙ্কাকাণ্ড - রাম-রাবণের যুদ্ধ । এখানে 'দুষ্টলোক কর্তৃক লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয়
বলতে বোঝানো হয়েছে বাজে লোকের আক্রমণ ।👉শরণাপন্ন _ শরণ
অর্থ সাহায্য বা আশ্রয় । শরণ ও আপন্ন শব্দ দু'টি যুক্ত
হয়ে শরণাপন্ন, অর্থাৎ আশ্রয় বা সাহায্যপ্রার্থী।👉 পর্ণকুটার _ পাতার
ঘর।👉 নিরাশ্রয়া _ আশ্রয়হীন
পাঠ-পরিচিতি: প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় সাধারণত বলা হয়ে থাকে, নারীর জন্য বরাদ্দ “ঘর", আর পুরুষের জন্য আছে “বাহির' ৷ অর্থাৎ পুরুষ সম্পৃক্ত থাকবে বাইরের জীবন ও জগতের সঙ্গে। অন্য দিকে,
গার্স্থ্য ও পারিবারিক জীবনে সীমাবদ্ধ থাকবে নারী । এ ধরনের
দৃষ্টিভঙ্গি সামজে পুরুষের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে; নারীকে
করে তোলে ঘরের সামশ্বী। কিন্তু নারীর সত্যিই কোনো ঘর বা গৃহ আছে কিনা- এ নিয়েই তৈরি হতে পারে প্রশ্ন; রোকেয়া সাখাওয়াত
হোসেন এ প্রশ্নটিই তুলেছেন “গৃহ' প্রবন্ধে । ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতাসূত্রে তিনি দেখিয়েছেন
পুরুষের আধিপত্য ও প্রতিপত্তির কাছে নারীর ঘরও বিপন্ন, ঘর
বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই। নারীর অর্থ, সম্পদ, সম্পত্তি ও জীবনযাপন- প্রায় সব কিছুর ওপর
প্রভাব বিস্তার করেছে পুরুষ । পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ ও সম্পত্তিও দখল করে নিয়েছে পুরুষ । প্রবন্ধটিতে বেশ কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে রোকেয়া দেখিয়েছেন পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও অভিভাবকতে নিজস্ব গৃহের আনন্দ ও অনুভূতি থেকে
নারী প্রবলভাবে বঞ্চিত । পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষ গৃহ বা
ঘর প্রকৃতপক্ষে মানুষের শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির স্থান।০১. ‘গৃহ’ রচনায়
প্রাবন্ধিক কাদেরকে ‘কূপমণ্ডুক’ বলেছেন? (ক) পুরুষদের (খ) মহিলাদের (গ) সমাজপতিদের (ঘ) রাজাদের উত্তর: খ
আহবান- [বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়]
লেখক পরিচিতি:
পরিচয়: লেখক ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে
মুরারিপুর গ্রামে (মামার বাড়িতে) চব্বিশ পরগনা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে মৃণালিনী
দেবীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃনিবাস একই জেলার ব্যারাকপুর গ্রামে।
সাহিত্য কর্ম:
📗 উপন্যাস: পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতি, দৃষ্টি প্রদীপ, আদর্শ হিন্দু হোটেল,
দেবযান, অশনি সংকেত ইত্যাতি।
📙 ছোটগল্প: মেঘমল্লার, মৌরিফুল, যাত্রাবদল, বিন্নর দল ইত্যাদি।
তিনি ১ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে
ঘাটশিলায় মৃত্যু বরণ করেন।
উৎস ও সারসংক্ষেপ: ‘আহবান’ গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
রচনাবলি থেকে সংকলিত। এটি একটি উদার মানবিক সম্পর্কের গল্প। মানুষের ¯স্নেহ, মমতা-প্রীতির যে বাঁধন তা
ধনসম্পদের নয়, হৃদয়ের নিবিড় আন্তরিকতার স্পর্শেই
গড়ে ওঠে। ধনী-দরিদ্রের শ্রেণিবিভাগ ও বৈষম্য,
বিভিন্ন ধর্মের
মানুষের মধ্যে সংস্কার ও গোঁড়ামির ফলে যে দূরত্ব গড়ে তাও ঘুচে যেতে পারে নিবিড় ¯স্নেহ, উদা হৃদয়ের আন্তরিকতা ও মানবীয়
দৃষ্টির ফলে। দারিদ্র-পীড়িত গ্রামের মানুষের সহজ-সরল জীবনধারার প্রতিফলনও এ গল্পের অন্যতম উপজীব্য। এ গল্পে লেখক দুটি ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও আর্থিক অবস্থানে বেড়ে ওঠা চরিত্রের মধ্যে সংকীর্ণতা ও
সংস্কারমুক্ত মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। গ্রামীণ লোকায়ত প্রান্তিক জীবনধারা শাস্ত্রীয়
কঠোরতা থেকে যে অনেকটা মুক্ত সে সত্যও এ গল্পে উন্মোচিত হয়েছে।
প্রথম লাইন- দেশের ঘরবাড়ি
নেই অনেকদিন থেকেই।
শেষ লাইন- সঙ্গে সঙ্গে মনে
হলো, ও বেঁচে থাকলে বলে উঠত,-সে মোর গোপাল।
ভাষারীতি- গল্পটি চলিতরীতিতে লেখা।
লেখক-পরিচিতি
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ সালের
১২ই সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের
চব্বিশ পরগনা জেলার মুরারিপুর গ্রামে
মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃনিবাস একই জেলার ব্যারাকপুর গ্রামে। বিভূতিভূষণের
বাল্য ও
কৈশোরকাল কাটে অত্যন্ত দারিদ্র্যে।
কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র।
১৯১৪ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯১৬ সালে
আইএ - উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে এবং ১৯১৮ সালে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করেন। তিনি দীর্ঘদিন
স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন এবং এর পাশাপাশি শহর থেকে দূরে অবস্থান করে নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যসাধনা
করেছেন। বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের জীবনকে তিনি তাঁর অসাধারণ শিল্পসুষমাময় ভাষায় সাহজিক
সারল্যে প্রকাশ করেছেন।
মানুষকে তিনি দেখেছেন গভীর মমত্ববোধ
ও নিবিড় ভালোবাসা দিয়ে। তাঁর গদ্য কাব্যময় ও চিত্রাত্মক বর্ণনায় সমৃদ্ধ। বিভূতিভূষণের কালজয়ী যুগল উপন্যাস
‘পথের পাঁচালী’,
‘অপরাজিতা’। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- উপন্যাস
: ‘দৃষ্টি প্রদীপ’, ‘আরণ্যক’, ‘দেবযান’ ও ‘ইছামতি’; গল্পগ্রন্থ : ‘মেঘমল্লার’, ‘মৌরিফুল’,
‘যাত্রাবদল’ ও ‘কিনড়বর দল’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৫০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন।
দেশের ঘরবাড়ি নেই অনেকদিন থেকেই।
পৈতৃক বাড়ি যা ছিল ভেঙেচুরে ভিটিতে জঙ্গল গজিয়েছে। এ অবস্থায় একদিন গিয়েছি দেশে কিসের
একটা ছুটিতে।
গ্রামের চক্কোত্তি মশায় আমার বাবার
পুরাতন বন্ধু। আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন-কতকাল
পরে বাবা মনে পড়ল দেশের কথা? প্রণাম করে পায়ের ধুলা নিলাম।
বললেন-এসো, এসো, বেঁচে থাকো, দীর্ঘজীবী হও। বাড়িঘর করবে না?- আজ্ঞে সামান্য মাইনে পাই-তাতে কী? গ্রামের ছেলে গ্রামে বাস করবে, এতে আর সামান্য মাইনে বেশি মাইনে কী? আমি খড় বাঁশ দিচ্ছি,
চালাঘর তুলে
ফেল, মাঝে মাঝে যাতায়াত করো।
আরও অনেকে এসে ধরল, অন্তত খড়ের ঘর ওঠাতে হবে। অনেক দিন পরে গ্রামে এসে লাগছে ভালোই।
বড় আমবাগানের মধ্য দিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছি,
আমগাছের ছায়ায়
একটি বৃদ্ধার চেহারা, ডান হাতে নড়ি ঠকঠক করতে করতে
বোধহয় বাজারের দিকে চলেছে। বুড়িকে দেখেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাবে?-বাজারে বাবা।
বুড়ি আমায় ভালো না দেখতে পেয়ে কিংবা
না চিনতে পেরে ডান হাত উঁচিয়ে তালু আড়ভাবে চোখের ওপর ধরল। বলল, কে বাবা তুমি? চেনলাম না তো?
-চিনবে না। আমি অনেক দিন গাঁয়ে আসি নি।
-তা হবে বাবা। আমি আগে তো এপাড়া-ওপাড়া যাতাম আসতাম না। তিনি থাকতি
অভাব ছিল না কোনো জিনিসের। গোলাপোরা ধান,
গোয়ালপোরা গরু।
-তোমাকে তো চিনতে পারলাম না, বুড়ি?
-আমার তো তেনার নাম করতে নেই বাবা। করাতের কাজ করতেন। বললাম, তোমার ছেলে আছে?-কেউ নেই বাবা, কেউ নেই। এক নাত-জামাই আছে তো সে মোরে ভাত দেয় না। আমার বড্ড
কষ্ট। ভাত জোটে না সবদিন।
বুড়িকে পকেট থেকে কিছু পয়সা বার করে
দিলাম।
-ব্যাপারটা এখানেই চুকে যাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু তা চুকল না।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেছি, এমন সময় সেই বুড়ি লাঠি ঠকঠক করতে করতে হাজির উঠোনে। থাকি এক
জ্ঞাতি খুড়োর বাড়ি। তিনি বললেন, ও হলো জমির করাতির স্ত্রী।
অনেকদিন আগে মরে গিয়েছে জমির। বুড়ি উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকল, ও বাবা। বোধহয় চোখে একটু কম দেখে। বললাম, এই যে আমি এখানে। আমার খুড়োমশায় বুড়িকে বুঝিয়ে দিলেন আমি কে।
সে উঠোনের কাঁঠালতলায় বসে আপন মনে খুব খানিকটা বকে গেল। পরদিন কলকাতা চলে গেলাম, ছুটি ফুরিয়ে গেল।
কয়েক মাস পরে জ্যৈষ্ঠ মাসে গরমের
ছুটিতে আমার নতুন তৈরি খড়ের ঘরখানাতে এসে উঠলাম। কলকাতাতে কর্মব্যস্ত এই ক’মাসের মধ্যে বুড়িকে একবারও মনে পড়েনি বা এখানে এসেও মনে হঠাৎ
হয়ত হতো না, যদি
সে তার পরের দিনই সকালে আমার ঘরের
নিচু দাওয়ায় এসে না বসে পড়ত।
বললাম, কী বুড়ি, ভালো আছ?
ময়লা ছেঁড়া কাপড়ের প্রান্ত থেকে গোটাকতক
আম খুলে আমার সামনে মাটিতে রেখে বলল, আমার কি মরণ আছে রে বাবা।
জিজ্ঞাসা করলাম, ও আম কীসের।
দন্তহীন মুখে একটু হাসবার চেষ্টা
করে বললে, অ গোপাল আমার, তোর জন্যি নিয়ে আলাম। গাছের আম বেশ কড়া মিষ্টি, খেয়ে দেখ এখন।
বড়ো ভালো লাগল। গ্রামে অনেকদিন থেকে
আপনার জন কেউ নেই। একটা ঘনিষ্ঠ আদরের সম্বোধন করার লোকের দেখা পাই নি বাল্যকালে মা-পিসিমা
মারা যাওয়ার পর থেকে। বুড়ি বললে, খাও কোথায় হ্যাঁ বাবা?- খুড়ো মশায়ের বাড়ি।
-বেশ যতড়ব করে তো ওনারা?- তা করে।
-দুধ পাচ্চ ভালো? -ঘুঁটি গোয়ালিনী দেয়, মন্দ না।
-ও বাবা, ওর দুধ! অর্ধেক জল- দুধ খেতি
পাচ্চ না ভালো সে বুঝেচি।
পরদিন সকাল হয়েছে সবে, বুড়ি দেখি উঠোনে এসে ডাকছে, অ গোপাল। বিছানা ছেড়ে উঠে বললাম, আরে এত সকালে কী মনে করে। হাতে কী?
বৃদ্ধা হাতের নড়ি আমার দাওয়ার গায়ে
ঠেস দিয়ে রেখে বলল, এক ঘটি দুধ আনলাম তোর জন্যি।-সে
কী! দুধ পেলে কোথায় এত সকালে?
আমায় মা বলে ডাকে ওই হাজরা ব্যাটার
বউ। তারও কেউ নেই। মোর চালাঘরের পাশে ওর চালাঘর। ওরে কাল রাত্তিরে বলে রেখে দিয়েছিলাম, বলি বউ আমার, গোপাল দুধ খেতি পায় না। তাই
আজ ভোরে উঠে দেখি আমারে ডাকচে, মা ওঠো, তোমার গোপালের জন্যি দুধ
নিয়ে যাও।
-আচ্ছা কেন বলতো তোমার এসব! এ রকম আর কখনও এনো না। কত পয়সা দাম
দিতে হবে বল। কতটা দুধ? বুড়ি একটু ঘাবড়ে গেল। ভয়ে
ভয়ে বলে, কেন বাবা, পয়সা কেন? -পয়সা না তো তুমি দুধ পাবে
কোথায়?
-ওই যে, বললাম বাবা, আমার মেয়ের বাড়ি থেকে।
-তা হোক, তুমি পয়সা নিয়ে যাও। সেও
তো গরিব লোক। বুড়ি পয়সা নিয়ে চলে গেল বটে কিন্তু সে যে দমে গিয়েছে তার কথাবার্তার ধরনে
বেশ বুঝতে পারলাম। মনে একটু কষ্ট হলো বুড়ি চলে গেলে। পয়সা দিতে যাওয়া ঠিক হয়েছে কি? বুড়ির কী রকম হয়ত মন পড়ে গিয়েছে আমার ওপর, ¯স্নেহের দান- এমন করা ঠিক হয়নি। বুড়ি কিন্তু এ
অবহেলা গায়ে মাখল না আদৌ। প্রতিদিন সকাল হতে না হতেই সে এসে জুটবে।
-অ গোপাল, এই দুটি কচি শসার জালি মোর
গাছের, এই ন্যাও। নুন দিয়ে খাও দিকিন মোর
সামনে? -বুড়ি তোমার চলে কীসে? -ওই যারে মেয়ে বলি,
ও বড্ড ভালো।
লোকের ধান ভানে, তাই চাল পায়, আমায় দুটো না দিয়ে খায় না।
-একা থাক? -তা একদিন মোর ঘরখানা না হয়
দেখতি গেলে, অ মোর গোপাল! আমি নতুন খাজুর পাতার
চেটাই বুনে রেখে দিয়েছিলাম তোমারে বসতি দেবার জন্যি। সেবার বুড়ির বাড়িতে আমার যাওয়া
ঘটে উঠল না। নানাদিকে ব্যস্ত থাকি। অনেক দিন পরে গ্রামে এসেছি তো!
যে কদিন গ্রামে থাকি বুড়ি রোজ সকালে
আসতে ভুলবে না। কিছু না কিছু আনবেই। কখনো পাকা আম, কখনো পাতি লেবু, কখনো বা একছড়া কাঁচকলা কি
এক-ফালি কুমড়ো। পুনরায় গ্রামে এলাম পাঁচ-ছয় মাস পরে, আশ্বিন মাসের শেষে। কয়েকদিন পরে ঘরে বসে আছি, বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে কে যেন জিজ্ঞাসা করলে; বাবু ঘরে আছেন গা?
বাইরে এসে দেখি গত জ্যৈষ্ঠ মাসে যাকে
বুড়ির সঙ্গে দেখেছিলাম সেই মধ্যবয়সী স্ত্রীলোকটি। আমায় দেখে সলজ্জভাবে মাথার কাপড়টা
আর একটু টেনে দেবার চেষ্টা করে সে বললে, বাবু কবে এসেছেন?
-দিন পাঁচ-ছয় হলো। কেন?
-আমার সেই মা পেটিয়ে দিলে, বলে দেখে এসো গিয়ে। -কে?
-ওই সেই বুড়ি- এখানে যিনি আসত। তেনার বড্ড অসুখ। এবার বোধহয় বাঁচবে
না। গোপাল কবে আসবে, গোপাল কবে আসবে- অস্থির, আমারে রোজ শুধায়। একবার দেখে আসুন গিয়ে, বড্ড খুশি হবে তাহলি।
বিকেলের দিকে বেড়াতে যাবার পথে দেখতে
গেলাম বুড়িকে। বুড়ি শুয়ে আছে একটা মাদুরের ওপর, মাথায় মলিন বালিশ। আমি গিয়ে কাছে দাঁড়াতেই বুড়ি চোখ মেলে আমার দিকে চাইল। পরে আমাকে
চিনে ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠবার চেষ্টা করতেই আমি বললাম, উঠো না, ও কী?
বুড়ি আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল, ভালো আছ অ মোর গোপাল?
বসতে দে গোপালকে।
বসতে দে।-বসবার দরকার নেই, থাক।
-গোপালেরে ওই খাজুরের চটখানা পেতে দে।
পরে ঠিক যেন আপনার মা কি পিসিমার
মতো অনুযোগের সুরে বলতে লাগল, তোর জন্যি খাজুরের চাটাইখানা
কদ্দিন আগে বুনে রেখেলাম। ওখানা পুরনো হয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে। তুই একদিনও এলি না গোপাল।
অসুখ হয়েছে তাও দেখতে এলি না। বুড়ির দুচোখ বেয়ে জল বেয়ে পড়ছে গড়িয়ে। আমায় বলল, গোপাল, যদি মরি, আমার কাফনের কাপড় তুই কিনে দিস।
আসবার সময় বুড়ির পাতানো মেয়েটির হাতে
কিছু দিয়ে এলাম পথ্য ও ফলের জন্য। হয়ত আর বেশি দিন বাঁচবে না, এই অসুখ থেকে উঠবে না।
বুড়ি কিন্তু সে যাত্রা সেরে উঠল।
বছরখানেক আর গ্রামে যাইনি। বোধহয় দেড় বছরও হতে পারে। একবার শরতের ছুটির পর তখনও দুইদিন
ছুটি হাতে আছে। গ্রামেই গেলাম এই দুইদিন কাটাতে। গ্রামে ঢুকতেই প্রথমে দেখা পরশু সর্দারের
বউ দিগম্বরীর সঙ্গে। দিগম্বরী অবাক হয়ে বলে,
ওমা আজই তুমি
এলে? সে বুড়ি যে কাল রাতে মারা গিয়েছে।
তোমার নাম করলো বড্ড। ওর সেই পাতানো
মেয়ে আজ সকালে বলছেল।
আমি এসেছি শুনে বুড়ির নাতজামাই দেখা
করতে এল। আমার মনে পড়ল বুড়ি বলেছিল সেই একদিন- আমি মরে গেলে তুই কাফনের কাপড় কিনে দিস
বাবা। ওর ¯স্নেহাতুর আত্মা বহু
দূর থেকে আমায় আহ্বান করে এনেছে। আমার মন হয়ত ওর ডাক এবার আর তাচ্ছিল্য করতে পারেনি।
কাপড় কেনবার টাকা দিলাম। নাতজামাই
বলে গেল, মাটি দেওয়ার সময় একবার যাবেন বাবু।
বেলা বারোটা আন্দাজ যাবেন।
শরতের কটুতিক্ত গন্ধ ওঠা বনঝোপ ও
মাকাল-লতা দোলানো একটা প্রাচীন তিত্তিরাজ গাছের তলায় বৃদ্ধাকে কবর দেওয়া হচ্ছে। আমি
গিয়ে বসলাম। আবদুল, শুকুর মিয়া, নসর, আমাদের সঙ্গে পড়ত আবেদালি, তার ছেলে গনি। এরা সকলে গাছের ছায়ায় বসে।
প্রবীণ শুকুর মিয়া আমায় দেখে বলল, এই যে বাবা, এসো। বুড়ির মাটি দেওয়ার দিন
তুমি কনে থেকে এলে, তুমি তো জানতে না? তোমায় যে বড্ড ভালোবাসত বুড়ি। দুজন জোয়ান ছেলে কবর খুঁড়ছে। কবর
দেওয়ার পর সকলে এক এক কোদাল মাটি দিল কবরের উপর। শুকুর মিয়া বলল, দ্যাও বাবা- তুমিও দ্যাও।
দিলাম এক কোদাল মাটি। সঙ্গে সঙ্গে
মনে হলো, ও বেঁচে থাকলে বলে উঠত,- অ মোর গোপাল। [সংক্ষেপিত]
শব্দার্থ ও টীকা
✉ চক্কোত্তী - ‘চক্রবর্তী’ উপাধির সংক্ষিপ্ত রূপ। পূজারী
ব্রাহ্মণের উপাধিবিশেষ।
✉ নড়ি - লাঠি।
✉ অন্ধের নড়ি- অসহায়ের একমাত্র অবলম্বন।
✉ গোলাপোরা- গোলাভরা। গেয়ালপোরা- গোয়ালভরা।
✉ করাতের কাজ- কাঠ চেরাই করার পেশা।
✉ করাতি- করাত দিয়ে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করে যে।
✉ দাওয়া- রোয়াক। বারান্দা।
পাঠ-পরিচিতি
“আহ্বান” গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
রচনাবলি থেকে সংকলিত হয়েছে। এটি একটি উদার মানবিক সম্পর্কের গল্প। মানুষের ¯স্নেহ-মমতা-প্রীতির যে বাঁধন তা ধনসম্পদে নয়, হৃদয়ের নিবিড় আন্তরিকতার স্পর্শেই গড়ে ওঠে। ধনী-দরিদ্রের শ্রেণিবিভাগ
ও বৈষম্য, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে যে
দূরত্ব সংস্কার ও গোঁড়ামির ফলে গড়ে ওঠে তাও ঘুচে যেতে পারে- নিবিড় ¯স্নেহ, উদার হৃদয়ের আন্তরিকতা ও মানবীয় দৃষ্টির ফলে। দারিদ্র্য-পীড়িত
গ্রামের মানুষের সহজ-সরল জীবনধারার প্রতিফলনও এই গল্পের অন্যতম উপজীব্য। এ গল্পে লেখক
দুটি ভিনড়ব ধর্ম, বর্ণ ও আর্থিক অবস্থানে বেড়ে-ওঠা
চরিত্রের মধ্যে সংকীর্ণতা ও সংস্কারমুক্ত মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। গ্রামীণ লোকায়ত
প্রান্তিক জীবনধারা শাস্ত্রীয় কঠোরতা থেকে যে অনেকটা মুক্ত সে-সত্যও এ গল্পে উন্মোচিত
হয়েছে।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
০১. “আহ্বান” গল্পে কথকের সহপাঠী কে ছিলেন?
ক. আবদুল খ.
আবেদালি গ. শুকুর মিয়া ঘ. নসর
০২. বুড়ি কেন বারবার গোপালের কাছে
যেতেন?
ক. পয়সা পাওয়ার লোভে খ.
স্নেবহ ভালোবাসার টানে
গ. নিঃসঙ্গতা দুর করতে ঘ. অতিথি পরায়ন বলে
গুরুত্বপূর্ণ লাইন:
গ্রামের চক্কোত্তি মশায় আমার বাবার পুরাতন বন্ধু।
আজ্ঞে সামন্য মাইনে পাই।
কখনো পাকা আম, কখনো পাতি লেবু, কখনো বা একছড়া কাঁচকলা কি এক-ফালি কুমড়ো।
ওর ¯স্নেহাতুর আত্মা বহু
দূর থেকে আমায় আহবান করে এনেছে।
শরতের কটুতিক্ত গন্ধ ওঠা বনঝোপ ও মাকল-লতা দোলানো একটি প্রাচীন
তিত্তিরাজ গাছের তলায় বৃদ্ধকে কবর দেওয়া হচ্ছে।
উৎস পরিচিত:
০১. ’দীর্ঘজীবী হও’ লেখককে এ কথা কে বলেছেন?- গ্রামের চক্কোওি মশায়।
০২. বুড়ির কে আছে?- নাতজামাই।
০৩. বুড়ির স্বামীর নাম কী?- জমির করাতি।
০৪. লেখক কোন মাসে তার খড়ের তৈরি
নতুন ঘরে উঠলেন?-জৈষ্ঠ মাসে গরমের ছুটিতে।
০৫. বুড়ি লেখকের জন্য সর্বপ্রথম কি
এনেছিল?-আম।
০৬. বুড়িকে দেখে লেখকের কার কথা মনে
পড়ল?- মা-পিসি।
০৭. লেখক কার বাড়িতে খেত?- খুড়ো মশায়।
০৮. গ্রামে এসে লেখকের ভালো লাগার
কারণ কী?- গ্রামের লোকদের আতিথেয়তা।
০৯. বুড়ি ’এপাড়া-ওপাড়া যাতাম আসতাম না’ বলতে কী বুঝিয়েছে?- ভিক্ষা।
১০. ”গোলাপোরা ধান, গোলাপোরা গরু’ বলতে বাংলার কী ফুটে উঠেছে?-স্বনির্ভরতা।
গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর🌈 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ম্যাট্রিক পাস করেন কত সালে?
উত্তর : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯১৪ সালে ম্যাট্রিক
পাস করেন।
🌈 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কোন বিভাগে উত্তীর্ণ হন?
উত্তর : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ম্যাট্রিক পরীক্ষায়
প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
🌈 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্মগ্রহণ করেন কোন জেলায়?
উত্তর : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় চব্বিশ পরগনা জেলায়
জন্মগ্রহণ করেন।
🌈 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
পেশা কী ছিল?
উত্তর : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পেশা ছিল শিক্ষকতা।
🌈 ‘পথের পাঁচালী'
উপন্যাসের লেখক
কে?
উত্তর : ‘পথের পাঁচালী' উপন্যাসের লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
🌈 “আহ্বান” গল্পের গল্পকথকের পৈতৃক বাড়ির
ভিটিতে কী গজিয়েছে?
উত্তর : “আহ্বান” গল্পের গল্পকথকের পৈতৃক বাড়ির ভিটিতে জঙ্গল গজিয়েছে।
🌈 ‘আহ্বান' গল্পটি কোন গ্রন্থ থেকে সংকলিত?
উত্তর : ‘আহ্বান' গল্পটি ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের' রচনাবলি থেকে।
🌈 বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কত সালে মৃত্যুবরণ করেন?
উত্তর : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫০ সালে মৃত্যুবরণ
করেন।
🌈 ঘর করবার জন্য গল্পকথকের বাবার বন্ধু কোন জিনিস দিয়েছিল?
উত্তর : ঘর করবার জন্য গল্পকথকের বাবার বন্ধু খড়, বাঁশ দিয়েছিল।
🌈 গল্পলেখকের বাবার বন্ধু গল্পকথককে কেমন ঘর তুলতে বললেন?
উত্তর : গল্পলেখকের বাবার বন্ধু গল্পকথককে চালাঘর তুলতে
বললেন।
🌈 “আহ্বান” গল্পের গল্পকথক চক্কোত্তি
মশাইকে দেখে কী করলেন?
উত্তর : “আহ্বান” গল্পের গল্পকথক চক্কোত্তি মশাইকে দেখে প্রণাম করলেন।
🌈 চক্কোত্তি মশাই গল্পকথককে গ্রামে কোন জিনিস করার কথা
বললেন?
উত্তর : চক্কোত্তি মশাই গল্পকথককে গ্রামে বাড়িঘর করার
কথা বললেন।
🌈 গল্পলেখক কীসের বাগানের মধ্য দিয়ে বাজারে গেল?
উত্তর : গল্পলেখক আম বাগানের মধ্য দিয়ে বাজারে গেল।
🌈 বাজারে যাবার সময় গল্পকথক বৃদ্ধাকে কোথায় দেখতে পেলেন?
উত্তর : বাজারে যাবার সময় গল্পকথক বৃদ্ধাকে আমগাছের ছায়ায়
দেখতে পেলেন।
🌈 কে থাকতে বুড়ির গোলাভরা ধান ও গোয়াল ভরা গরু ছিল?
উত্তর : স্বামী থাকতে বুড়ির গোলাভরা ধান ও গোয়াল ভরা
গরু ছিল।
🌈 বৃদ্ধা নড়ি ঠকঠক করতে করতে কোথায় যাচ্ছিল?
উত্তর: বৃদ্ধা নড়ি ঠকঠক করতে করতে বাজারে যাচ্ছিল।
🌈 বৃদ্ধা বুড়িকে দেখা মাত্রই গল্পলেখক কী করলেন?
উত্তর: বৃদ্ধা বুড়িকে দেখামাত্রই গল্পলেখক দাঁড়িয়ে গেলেন।
🌈 ‘তিনি থাকতে অভাব ছিল না কোন জিনিসের'-“আহ্বান” গল্পে এ উক্তিটির ‘তিনি’ কে?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পে এই ‘তিনি’ হলেন বুড়ির স্বামী।
🌈 “আহ্বান” গল্পের বুড়ির স্বামী পেশায়
কী ছিলেন?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পের বুড়ির স্বামী পেশায় করাতি ছিলেন।
🌈 স্বামী মারা যাবার পর আপন বলতে জগতে বুড়ির কে বর্তমান
আছে?
উত্তর: স্বামী মারা যাবার পর আপন বলতে জগতে বুড়ির বর্তমান
আছে এক নাতজামাই।
🌈 বুড়ি কাকে উঠোনের কাঁঠালতলায় আপন মনে বকে গেল?
উত্তর: বুড়ি গল্পকথককে উঠোনের কাঁঠালতলায় আপন মনে বকে
গেল।
🌈 বুড়ি গল্পকথকের জন্য ময়লা ছেঁড়া কাপড়ের প্রান্তে বেঁধে
কী নিয়ে এসেছিল?
উত্তর: বুড়ি গল্পকথকের জন্য ময়লা ছেঁড়া কাপড়ের প্রান্তে
বেঁধে আম নিয়ে এসেছিল।
🌈 “আহ্বান” গল্পের গল্পকথকের সামনে কে দন্তহীন মুখে হাসবার চেষ্টা করল?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পের গল্পকথকের সামনে বুড়ি দন্তহীন মুখে হাসবার চেষ্টা করল।
🚩 গল্পকথক গ্রামে কার বাড়িতে থাকেন?
উত্তর: গল্পকথক গ্রামে এক জ্ঞাতি খুড়োর বাড়িতে থাকেন।
🚩 “আহ্বান” গল্পের বুড়ির স্বামীর নাম
কী?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পের বুড়ির স্বামীর নাম জমির।
🚩 কে গল্পকথককে বুড়ির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন?
উত্তর: গল্পকথকের খুড়ো মশায় গল্পকথককে বুড়ির সঙ্গে পরিচয়
করিয়ে দিলেন।
🚩 বুড়ির আনা আমগুলোকে কী রকম বলে উলে¬খ করেছেন?
উত্তর: বুড়ির আনা আমগুলোকে কড়া মিষ্টি বলে উলে¬খ করেছেন।
🚩 “আহ্বান” গল্পের বুড়িকে কে দুধ দিয়েছিল?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পের বুড়িকে হাজরার বউ দুধ দিয়েছিল।
🚩 “আহ্বান” গল্পের হাজরার বউ বুড়িকে
কী বলে ডাকে?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পের হাজরার বউ বুড়িকে মা বলে ডাকে।
🚩 কে বুড়িকে খাবার না দিয়ে খায় না?
উত্তর: হাজরার বউ বুড়িকে খাবার না দিয়ে খায় না।
🚩 হাজরার বউয়ের পেশা কী ছিল?
উত্তর: হাজরার বউয়ের পেশা ছিল ধান ভানা।
🚩 বুড়ি কথিত গোপালকে কী দেখতে যেতে বলে?
উত্তর: বুড়ি কথিত গোপালকে ঘরখানা দেখতে যেতে বলে।
🚩 বুড়ি গল্পকথকের বসবার জন্য ঘরে কী তৈরি করেছিল?
উত্তর: বুড়ি গল্পকথকের বসবার জন্য ঘরে খেজুর পাতার চাটাই
তৈরি করেছিল।
🚩 গল্পকথক গ্রামে থাকা অবস্থায় কে রোজ সকালে আসতে ভোলে
না?
উত্তর: গল্পকথক
গ্রামে থাকা অবস্থায় বুড়ি রোজ সকালে আসতে ভোলে না।
🚩 গল্পকথকের খাবার দুধ কোথা থেকে আসে?
উত্তর: গল্পকথকের খাবার দুধ ঘুঁটি গোয়ালিনীর কাছ থেকে
আসে।
🚩 বুড়ির দৃষ্টিতে ঘুঁটি গোয়ালিনীর দুধে অর্ধেক কী?
উত্তর: বুড়ির দৃষ্টিতে ঘুঁটি গোয়ালিনীর দুধে অর্ধেক জল
থাকে।
🚩 “আহ্বান” গল্পের বুড়ি গল্পকথককে কী
নামে ডাকে?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পের বুড়ি গল্পকথককে ‘গোপাল’ নামে ডাকে।
🚩 অসুস্থ বুড়িকে গল্পকথক কখন
দেখতে গেলেন?
উত্তর: অসুস্থ বুড়িকে গল্পকথক বিকেলে দেখতে গেলেন।
🚩 “আহ্বান” গল্পের বুড়ি কীসের উপর শুয়েছিল?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পের বুড়ি মাদুরের উপর শুয়েছিল।
🚩 বুড়ি কাকে দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল?
উত্তর: বুড়ি গোপালকে দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল।
🚩 “আহ্বান” গল্পে কার দুচোখ বেয়ে জল
গড়িয়ে পড়ে?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পে বুড়ির দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
🚩 শেষবারে গ্রামে ঢুকতেই গল্পলেখকের কার সাথে দেখা হয়?
উত্তর: শেষবারে গ্রামে ঢুকতেই গল্পলেখকের দিগম্বরীর সাথে
দেখা হয়।
🚩 দিগম্বরী কে?
উত্তর: দিগম্বরী পরশু সর্দারের বৌ।
🚩 গল্পকথক কার কাছ থেকে প্রথমে বুড়ির মৃত্যুর সংবাদ শুনতে
পায়?
উত্তর: গল্পকথক দিগম্বরীর কাছে থেকে প্রথমে বুড়ির মৃত্যুর
সংবাদ শুনতে পায়।
🚩 ‘ওর স্নেহাতুর আত্মা বহু দূর থেকে আমায় আহ্বান করে এনেছে।’-“আহ্বান” গল্পে কার আত্মার কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পে বুড়ির কথা বলা হয়েছে।
🚩 “আহ্বান” গল্পে আবদুল, শুকুর, নসর-এরা লেখকের কী হতেন?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পে আবদুল, শুকুর, নসর-এরা লেখকের স্কুল জীবনের
বন্ধু হতেন।
🚩 কারা বুড়ির কবর খুঁড়েছে?
উত্তর: দুজন জোয়ান ছেলে বুড়ির কবর খুঁড়েছে।
🚩 বুড়ি কার জন্য খেজুর পাতার চাটাই বুনে রেখেছিল?
উত্তর: বুড়ি গল্পকথকের জন্য খেজুর পাতার চাটাই বুনে রেখেছিল।
🚩 বুড়ি কথিত গোপালের জন্য ঘটিতে কী এনেছিল?
উত্তর: বুড়ি কথিত গোপালের জন্য ঘটিতে দুধ এনেছিল।
🚩 “আহ্বান” গল্পের কার মন বুড়ির ডাক
তাচ্ছিল্য করতে পারেনি?
উত্তর: “আহ্বান” গল্পের গল্পলেখকের মন বুড়ির ডাক তাচ্ছিল্য করতে পারেনি।
🚩 গল্পকথক কাপড় কিনতে কার কাছে টাকা দিল?
উত্তর: গল্পকথক কাপড় কিনতে বুড়ির নাতজামাইয়ের কাছে টাকা
দিল।
🚩 বুড়িকে আনুমানিক কয়টায় দাফন করা হয়েছিল?
উত্তর: বুড়িকে আনুমানিক বেলা বারোটায় দাফন করা হয়েছিল।
🚩 বুড়িকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছিল?
উত্তর: বুড়িকে একটা প্রাচীন গাছের তলায় কবর দেয়া হয়েছিল।
🚩 গল্পকথক পকেট থেকে বুড়িকে কী বের করে দিয়েছিল?
উত্তর: গল্পকথক পকেট থেকে বুড়িকে পয়সা বের করে দিয়েছিল।
🚩 বাল্যকালে কার মা-পিসি মারা গিয়েছে?
উত্তর: বাল্যকালে গল্পকথকের মা-পিসি মারা গিয়েছে।
মানব-কল্যাণ [আবুল ফজল]
মাসি-পিসি [মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়]
বায়ান্নর দিনগুলো [শেখ মুজিবুর রহমান]
লেখক-পরিচিতি
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ
বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও
জাতির জনক। তাঁর জন্ম ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়। তাঁর
পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতি ও দেশব্রতে
যুক্ত হন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
আইন বিভাগে অধ্যয়ন করেন। ভাষা-আন্দোলনসহ বিভিনড়ব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি
বহুবার কারাবরণ করেছেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পূর্ববাংলার প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ
করে দেশব্যাপী সফরের মাধ্যমে মানুষের মনে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি
করেন। বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে এক সর্বাত্মক আন্দোলন
গড়ে তুলে তিনি সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে তৎকালীন
পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে
অসহযোগের ডাক দেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি
ঘোষণা করেন : “এবারের সংগ্রাম
আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম
স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে
নস্যাৎ করার জন্যে ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পরে পাকিস্তানি বাহিনী
বাঙালির এই অবিসংবাদিত
নেতাকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ
প্রম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে
তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি
তিনি দেশে ফেরেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার মহান দায়িত্বে ব্রতী হন। বাঙালির অবিসংবাদিত
নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান
জীবদ্দশায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাঙালি যিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে
বাংলায় ভাষণ দেন। ১৯৭২ সালে তিনি ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই
আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে তিনি সপরিবারে নিহত
হন। এদিকে জেলের ভেতর আমরা দুইজনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম অনশন ধর্মঘট করার জন্য। আমরা আলোচনা
করে ঠিক করেছি, যাই হোক না কেন, আমরা অনশন ভাঙব না। যদি এই পথেই মৃত্যু এসে
থাকে তবে তাই হবে। জেল কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে সুপারিনটেনডেন্ট আমীর হোসেন সাহেব ও তখনকার
দিনে রাজবন্দিদের ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান সাহেব আমাদের বুঝাতে অনেক চেষ্টা করলেন।
আমরা তাঁদের বললাম, আপনাদের বিরুদ্ধে
আমাদের বলবার
কিছু নাই। আর আমরা সেজন্য অনশন করছি না। সরকার আমাদের বৎসরের পর বৎসর বিনা বিচারে আটক
রাখছে, তারই প্রতিবাদ
করার জন্য অনশন ধর্মঘট করছি। এতদিন জেল খাটলাম, আপনাদের সাথে আমাদের মনোমালিন্য হয় নাই। কারণ আমরা
জানি যে, সরকারের হুকুমেই
আপনাদের চলতে হয়।
১৫ই ফেব্রুয়ারি
তারিখে সকালবেলা আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলো এই কথা বলে যে, আমার সাথে আলোচনা আছে অনশন ধর্মঘটের ব্যাপার
নিয়ে। আমি যখন জেলগেটে পৌঁছালাম দেখি, একটু পরে মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। কয়েক মিনিট
পরে আমার মালপত্র, কাপড়চোপড় ও বিছানা
নিয়ে জমাদার
সাহেব হাজির। বললাম, ব্যাপার কী? কর্তৃপক্ষ বললেন, আপনাদের অন্য জেলে পাঠানোর হুকুম হয়েছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, কোন জেলে? কেউ কিছু বলেন না। এদিকে আর্মড পুলিশ, আইবি অফিসারও প্রস্তুত হয়ে এসেছে। খবর চাপা
থাকে না। একজন আমাকে বলে দিল,
ফরিদপুর জেলে। দুইজনকেই এক জেলে
পাঠানো হচ্ছে।
তখন নয়টা বেজে গেছে। এগারোটায় নারায়ণগঞ্জ থেকে জাহাজ ছাড়ে, সেই জাহাজ আমাদের ধরতে হবে। আমি দেরি করতে
শুরু করলাম, কারণ তা না হলে
কেউই জানবে না আমাদের কোথায় পাঠাচ্ছে!
প্রথমে আমার
বইগুলি এক এক করে মেলাতে শুরু করলাম, তারপর কাপড়গুলি। হিসাব-নিকাশ, কত টাকা খরচ হয়েছে, কত টাকা আছে। দেরি করতে করতে দশটা বাজিয়ে
দিলাম। রওয়ানা করতে আরও আধা ঘণ্টা লাগিয়ে দিলাম। আর্মড পুলিশের সুবেদার ও গোয়েন্দা
কর্মচারীরা তাড়াতাড়ি করছিল। সুবেদার পাকিস্তান হওয়ার সময় গোপালগঞ্জে ছিল এবং সে একজন
বেলুচি ভদ্রলোক। আমাকে খুবই ভালোবাসত এবং শ্রদ্ধা করত। আমাকে দেখেই বলে বসল, ইয়ে কেয়া বাত হ্যায়, আপ জেলখানা মে। আমি বললাম, কিসমত। আর কিছুই বললাম না।
আমাদের জন্য
বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি আনা হয়েছে। গাড়ির ভেতর জানালা উঠিয়ে ও দরজার কপাট বন্ধ করে দিল।
দুইজন ভেতরেই
আমাদের সাথে বসল। আর একটা গাড়িতে অন্যরা পেছনে পেছনে ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে রোডের
দিকে চলল। সেখানে যেয়ে দেখি পূর্বেই একজন আর্মড পুলিশ ট্যাক্সি রিজার্ভ করে দাঁড়িয়ে
আছে। তখন ট্যাক্সি পাওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। আমরা আস্তে আস্তে নামলাম ও উঠলাম। কোনো চেনা
লোকের সাথে দেখা হলো না। যদিও এদিক ওদিক অনেকবার তাকিয়ে ছিলাম। ট্যাক্সি তাড়াতাড়ি চালাতে
বলল। আমি ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, “বেশি জোরে চালাবেন না, কারণ বাবার কালের জীবনটা যেন রাস্তায় না যায়।”
আমরা পৌঁছে
খবর পেলাম জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। এখন উপায়? কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে? রাত একটায় আর একটা জাহাজ ছাড়বে। আমাদের নারায়ণগঞ্জ
থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। ওপরওলাদের টেলিফোন করল এবং হুকুম নিল থানায়ই রাখতে। আমাদের পুলিশ
ব্যারাকের একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।
রাত এগারোটায়
আমরা স্টেশনে আসলাম। জাহাজ ঘাটেই ছিল, আমরা উঠে পড়লাম। জাহাজ না ছাড়া পর্যন্ত সহকর্মীরা অপেক্ষা করল।
রাত একটার সময় সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বললাম, “জীবনে আর দেখা না হতেও পারে। সকলে যেন আমাকে ক্ষমা
করে দেয়। দুঃখ আমার নাই। একদিন মরতেই হবে, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে।”
জাহাজ ছেড়ে দিল, আমরা বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। সকালে দুইজনে
পরামর্শ করে ঠিক করলাম, জাহাজে অনশন
করি কী করে? আমাদের জেলে
নিতে হবে অনশন শুরু করার পূর্বে। সমস্ত দিন জাহাজ চলল, রাতে গোয়ালন্দ ঘাটে
এলাম। সেখান
থেকে ট্রেনে রাত চারটায় ফরিদপুর পৌঁছালাম। রাতে আমাদের জেল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করল না।
আমরা দুইজনে
জেল সিপাহিদের ব্যারাকের বারান্দায় কাটালাম। সকালবেলা সুবেদার সাহেবকে বললাম, “জেল অফিসাররা না আসলে
তো আমাদের জেলে নিবে না, চলেন কিছু নাশতা
করে আসি।” নাশতা খাবার
ইচ্ছা আমাদের
নাই। তবে যদি
কারও সাথে দেখা হয়ে যায়, তাহলে ফরিদপুরের
সহকর্মীরা জানতে পারবে, আমরা ফরিদপুর
জেলে আছি এবং অনশন ধর্মঘট করছি। আধাঘণ্টা দেরি করলাম, কাউকেও দেখিনা-চায়ের দোকানের মালিক এসেছে,
তাকে আমি আমার
নাম বললাম এবং খবর দিতে বললাম আমার সহকর্মীদের। আমরা জেলের দিকে রওয়ানা করছি, এমন সময় আওয়ামী লীগের এক কর্মী, তার নামও মহিউদ্দিন-সকলে মহি বলে ডাকে, তার সঙ্গে দেখা। আমি যখন
ফরিদপুরে ১৯৪৬
সালের ইলেকশনে ওয়ার্কার ইনচার্জ ছিলাম, তখন আমার সাথে সাথে কাজ করেছে। মহি সাইকেলে যাচ্ছিল, আমি তাকে দেখে ডাক দিলাম নাম ধরে, সে সাইকেল থেকে আমাকে দেখে এগিয়ে আসল।
আইবি নিষেধ করছিল।
আমি শুনলাম না, তাকে এক ধমক
দিলাম এবং মহিকে বললাম, আমাদের ফরিদপুর
জেলে এনেছে এবং আজ থেকে অনশন করছি সকলকে এ খবর দিতে।
আমরা জেলগেটে
এসে দেখি, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার সাহেব এসে গেছেন। আমাদের তাড়াতাড়ি
ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন। তাঁরা পূর্বেই খবর পেয়েছিলেন। জায়গাও ঠিক করে রেখেছেন, তবে রাজবন্দিদের সাথে নয়, অন্য জায়গায়। আমরা তাড়াতাড়ি ঔষধ খেলাম পেট
পরিষ্কার করবার জন্য। তারপর অনশন ধর্মঘট
শুরু করলাম।
দুই দিন পর অবস্থা খারাপ হলে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের দুইজনেরই শরীর
খারাপ। মহিউদ্দিন ভুগছে প্লুরিসিস রোগে, আর আমি ভুগছি নানা রোগে। চার দিন পরে আমাদের নাক দিয়ে জোর করে
খাওয়াতে শুরু করল। মহাবিপদ! নাকের ভিতর দিয়ে নল পেটের মধ্যে পর্যন্ত দেয়। তারপর
নলের মুখে একটা
কাপের মতো লাগিয়ে দেয়। একটা ছিদ্রও থাকে। সে কাপের মধ্যে দুধের মতো পাতলা করে খাবার
তৈরি করে পেটের ভেতর ঢেলে দেয়। এদের কথা হলো, “মরতে দেব না।” আমার নাকে একটা ব্যারাম ছিল। দুই-তিনবার দেবার পরেই ঘা হয়ে গেছে।
রক্ত আসে আর যন্ত্রণা পাই।
আমরা আপত্তি
করতে লাগলাম। জেল কর্তৃপক্ষ শুনছে না। খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমার দুইটা নাকের ভেতরই ঘা
হয়ে গেছে। তারা হ্যান্ডকাফ পরানোর লোকজন নিয়ে আসে। বাধা দিলে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে জোর
করে ধরে খাওয়াবে। আমাদের শরীরও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাঁচ-ছয় দিন পরে বিছানা থেকে
ওঠার শক্তি হারিয়ে
ফেলেছি। আমরা
ইচ্ছা করে কাগজি লেবুর রস দিয়ে লবণ পানি খেতাম। কারণ এর মধ্যে কোনো ফুড ভ্যালু নাই।
আমাদের ওজনও কমতে ছিল। নাকের মধ্য দিয়ে নল দিয়ে খাওয়ার সময় নলটা একটু এদিক ওদিক হলেই
আর উপায় থাকবে না। সিভিল সার্জন সাহেব, ডাক্তার সাহেব ও জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো অসুবিধা
না হয়, তার চেষ্টা করছিলেন। বার বার সিভিল সার্জন
সাহেব অনশন করতে নিষেধ করছিলেন। আমার ও মহিউদ্দিনের শরীর অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন
আর বিছানা থেকে উঠবার শক্তি নাই। আমার হার্টের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে বুঝতে পারলাম।
প্যালপিটিশন হয় ভীষণভাবে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ভাবলাম
আর বেশি দিন
নাই। একজন কয়েদিকে দিয়ে গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনালাম। যদিও হাত কাঁপে তথাপি ছোট ছোট
করে চারটা চিঠি লিখলাম। আব্বার কাছে একটা, রেণুর কাছে একটা, আর দুইটা শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের কাছে। দু-একদিন পরে আর
লেখার শক্তি থাকবে না।
একুশে ফেব্রুয়ারি
আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে
দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা
ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল
হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল।
তারা বিভিনড়ব স্লোগান দিচ্ছিল,
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’,
‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ আরও অনেক স্লোগান। আমার খুব খারাপ লাগল।
কারণ, ফরিদপুর আমার জেলা, মহিউদ্দিনের নামে কোনো স্লোগান দিচ্ছে না
কেন? শুধু ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ বললেই তো হতো। রাতে যখন ঢাকার খবর পেলাম
তখন ভীষণ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লাম। কত লোক মারা গেছে বলা কষ্টকর। তবে অনেক লোক গুলি খেয়ে
মারা গেছে শুনেছি।
দুজনে পাশাপাশি
বিছানায় শুয়ে আছি। ডাক্তার সাহেব আমাদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু উত্তেজনায়
উঠে বসলাম।
২২ তারিখে সারা
দিন ফরিদপুরে শোভাযাত্রা চলল। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী এক জায়গায় হলেই স্লোগান দেয়।
ছোট্ট ছোট্ট
ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেড়ায় আর স্লোগান দেয়। ২২ তারিখে খবরের কাগজ এল, কিছু কিছু খবর পেলাম। মুসলিম লীগ সরকার কত
বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই
প্রথম বাঙালিরাই
রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল
আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে
কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হলো মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না
করে গ্রেফতার করলেই তো চলত।
আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা
ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।
খবরের কাগজে দেখলাম, মাওলানা আবদুর
রশিদ তর্কবাগীশ এমএলএ, খয়রাত হোসেন
এমএলএ, খান সাহেব ওসমান
আলী এমএলএ এবং মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও খোন্দকার মোশতাক আহমদসহ শত শত ছাত্র ও কর্মীকে
গ্রেফতার করেছে। দু-একদিন পরে দেখলাম কয়েকজন প্রফেসর, মওলানা ভাসানী, শামসুল হক সাহেব ও বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও
কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। নারায়ণগঞ্জে খানসাহেব ওসমান আলীর বাড়ির ভেতরে
ঢুকে ভীষণ মারপিট
করেছে। বৃদ্ধ খান সাহেব ও তাঁর ছেলেমেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। সমস্ত ঢাকায়
ও নারায়ণগঞ্জে এক ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মীই বোধহয় আর
জেলখানার বাইরে নাই।
আমাদের অবস্থা
এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে-কোনো মুহূর্তে
মৃত্যুর শান্তি-ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে
পাঁচ-সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ
দেখলাম, তার মুখ গম্ভীর
হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে, মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, আমার দিন ফুরিয়ে গেছে। কিছু সময় পরে আবার
ফিরে এসে বললেন, “এভাবে মৃত্যুবরণ
করে কি কোনো লাভ হবে? বাংলাদেশ যে
আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে।” আমার কথা বলতে কষ্ট হয়, আস্তে আস্তে বললাম, “অনেক লোক আছে। কাজ পড়ে
থাকবে না। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসি, তাদের জন্যই জীবন দিতে পারলাম, এই শান্তি।” ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, “কাউকে খবর দিতে হবে কি
না? আপনার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী
কোথায়? আপনার আব্বার
কাছে কোনো টেলিগ্রাম
করবেন?” বললাম, “দরকার নাই। আর তাদের
কষ্ট দিতে চাই না।” আমি আশা ছেড়ে
দিয়েছি, হাত-পা অবশ হয়ে
আসছিল। হার্টের দুর্বলতা না থাকলে এত তাড়াতাড়ি দুর্বল হয়ে পড়তাম না। একজন কয়েদি ছিল, আমার হাত-পায়ে সরিষার তেল গরম করে মালিশ
করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
মহিউদ্দিনের
অবস্থাও ভালো না, কারণ প্লুরিসিস
আবার আμমণ করে বসেছে।
আমার চিঠি চারখানা একজন কর্মচারীকে ডেকে তাঁর কাছে দিয়ে বললাম, আমার মৃত্যুর পরে চিঠি চারখানা ফরিদপুরে
আমার এক আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দিতে। তিনি কথা দিলেন, আমি তাঁর কাছ থেকে ওয়াদা নিলাম। বার বার আব্বা, মা, ভাইবোনদের চেহারা ভেসে আসছিল আমার চোখের সামনে।
রেণুর দশা কী হবে? তার তো কেউ নাই
দুনিয়ায়। ছোট ছেলেমেয়ে দুইটার অবস্থাই বা কী হবে? তবে আমার আব্বা ও ছোট ভাই ওদের ফেলবে না, এ বিশ্বাস আমার ছিল। চিন্তাশক্তিও হারিয়ে
ফেলছিলাম। হাচিনা, কামালকে একবার
দেখতেও পারলাম না। বাড়ির কেউ খবর পায় নাই, পেলে নিশ্চয়ই আসত।
মহিউদ্দিন ও
আমি পাশাপাশি দুইটা খাট পেতে নিয়েছিলাম। একজন আরেকজনের হাত ধরে শুয়ে থাকতাম। দুজনেই
চুপচাপ পড়ে থাকি। আমার বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। সিভিল সার্জন সাহেবের কোনো সময়-অসময়
ছিল না। আসছেন, দেখছেন, চলে যাচ্ছেন। ২৭ তারিখ দিনের বেলা আমার অবস্থা
আরও খারাপ হয়ে পড়ল।
বোধহয় আর দু-একদিন
বাঁচতে পারি। ২৭ তারিখ রাত আটটার সময় আমরা দুইজন চুপচাপ শুয়ে আছি। কারও সাথে কথা বলার
ইচ্ছাও নাই, শক্তিও নাই।
দুইজনেই শুয়ে
শুয়ে কয়েদির সাহায্যে ওজু করে খোদার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছি। দরজা খুলে বাইরে থেকে ডেপুটি
জেলার এসে আমার কাছে বসলেন এবং বললেন, “আপনাকে যদি মুক্তি দেওয়া হয়, তবে খাবেন তো?” বললাম,
“মুক্তি দিলে খাব, না দিলে খাব না। তবে আমার লাশ মুক্তি পেয়ে
যাবে।” ডাক্তার সাহেব
এবং আরও কয়েকজন কর্মচারী এসে গেছে, চেয়ে দেখলাম। ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, “আমি পড়ে শোনাই, আপনার মুক্তির অর্ডার
এসে গেছে রেডিওগ্রামে
এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অফিস থেকেও অর্ডার এসেছে। দুইটা অর্ডার পেয়েছি।” তিনি পড়ে শোনালেন, আমি বিশ্বাস করতে চাইলাম না। মহিউদ্দিন শুয়ে
শুয়ে অর্ডারটা দেখল এবং বলল যে,
“তোমার অর্ডার এসেছে।” আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ডেপুটি
সাহেব বললেন, “আমাকে অবিশ্বাস
করার কিছুই নাই। কারণ, আমার কোনো স্বার্থ
নাই; আপনার মুক্তির আদেশ সত্যিই
এসেছে।” ডাক্তার সাহেব
ডাবের পানি আনিয়েছেন। মহিউদ্দিনকে দুইজন ধরে বসিয়ে দিলেন। সে আমাকে বলল, “তোমাকে ডাবের পানি আমি
খাইয়ে দিব।” দুই চামচ ডাবের
পানি দিয়ে মহিউদ্দিন আমার অনশন ভাঙিয়ে দিল।
সকাল দশটার দিকে
খবর পেলাম, আব্বা এসেছেন।
জেলগেটে আমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই কর্তৃপক্ষ তাঁকে ভিতরে নিয়ে আসলেন। আমাকে দেখেই
আব্বার চোখে পানি এসে গেছে। আব্বার সহ্যশক্তি খুব বেশি। কোনোমতে চোখের পানি মুছে ফেললেন।
কাছে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং বললেন, তোমার মুক্তির আদেশ হয়েছে, তোমাকে আমি নিয়ে যাব বাড়িতে। আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম
তোমার মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে, দুই দিন বসে রইলাম, কেউ খবর দেয় না, তোমাকে কোথায় নিয়ে গেছে। তুমি ঢাকায় নাই
একথা জেলগেট
থেকে বলেছে। যদিও পরে খবর পেলাম, তুমি ফরিদপুর জেলে আছ। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ। নারায়ণগঞ্জ
এসে যে জাহাজ ধরব তারও উপায় নেই। তোমার মা ও রেণুকে ঢাকায় রেখে আমি চলে এসেছি। কারণ, আমার সন্দেহ হয়েছিল তোমাকে ফরিদপুর নেওয়া
হয়েছে কি না! আজই টেলিগ্রাম করব, তারা যেন বাড়িতে রওয়ানা হয়ে যায়। আমি আগামীকাল বা পরশু তোমাকে
নিয়ে রওয়ানা করব, বাকি খোদা ভরসা।
সিভিল সার্জন
সাহেব বলেছেন, তোমাকে নিয়ে
যেতে হলে লিখে দিতে হবে যে,
“আমার দায়িত্বে নিয়ে যাচ্ছি।” আব্বা আমাকে সান্ত¡না দিলেন এবং বললেন, তিনি খবর পেয়েছেন মহিউদ্দিনও মুক্তি পাবে, তবে একসাথে ছাড়বে না, একদিন পরে ছাড়বে।
পরের দিন আব্বা
আমাকে নিতে আসলেন। অনেক লোক জেলগেটে হাজির। আমাকে স্ট্রেচারে করে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া
হলো এবং গেটের বাইরে রেখে দিল,
যদি কিছু হয় বাইরে গিয়ে হোক, এই তাদের ধারণা।
পাঁচদিন পর বাড়ি
পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, “আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।” একুশে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে। কামাল আমার কাছে
আসল না, তবে আমার দিকে
চেয়ে রইল। আমি খুব দুর্বল, বিছানায় শুয়ে
পড়লাম। গতকাল
রেণু ও মা ঢাকা থেকে বাড়ি এসে আমার প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছিল। এক এক করে সকলে যখন আমার
কামরা থেকে বিদায় নিল, তখন রেণু কেঁদে
ফেলল এবং বলল, তোমার চিঠি পেয়ে
আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা
করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব
নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই
বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম। আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
তাই রওয়ানা করলাম ঢাকায়, সোজা আমাদের
বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা নিয়ে। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়া মায়া
আছে? আমাদের কারও কথাও তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কী উপায় হতো? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কী করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের অবস্থা কী হতো? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হতো না? মানুষ কি শুধু খাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে
চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই-বা
কীভাবে করতা?’
আমি তাকে কিছুই
বললাম না। তাকে বলতে দিলাম, কারণ মনের কথা
প্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছু কমে যায়। রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। শুধু বললাম, “উপায় ছিল না।” বাচ্চা দুইটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়লাম।
সাতাশ-আটাশ মাস পরে আমার সেই পুরানা জায়গায়, পুরানা কামরায়, পুরানা
বিছানায় শুয়ে
কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের দিনগুলির কথা মনে পড়ল। ঢাকার খবর সবই পেয়েছিলাম।
মহিউদ্দিনও মুক্তি
পেয়েছে। আমি বাইরে এলাম আর আমার সহকর্মীরা আবার জেলে গিয়েছে। পরের দিন সকালে আব্বা
ডাক্তার আনালেন। সিভিল সার্জন সাহেবের পেঙসμিপশনও ছিল। ডাক্তার সকলকে বললেন, আমাকে যেন বিছানা থেকে উঠতে না দেওয়া হয়।
দিন দশেক পরে আমাকে হাঁটতে হুকুম দিল শুধু বিকেলবেলা। আমাকে দেখতে রোজই অনেক লোক বাড়িতে
আসত। গোপালগঞ্জ, খুলনা ও বরিশাল
থেকেও আমার কিছু সংখ্যক সহকর্মী এসেছিল।
একদিন সকালে
আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা
ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল
হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দুজনেই
শুনলাম। আস্তে
আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা।”
কামাল আমার কাছে
আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক
দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক
মাস। রাজনৈতিক
কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে
দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আজ দুইশত বৎসর পরে আমরা
স্বাধীন হয়েছি। সামান্য হলেও কিছু আন্দোলনও করেছি স্বাধীনতার জন্য। ভাগ্যের নিষ্ঠুর
পরিহাস, আজ আমাকে ও আমার
সহকর্মীদের বছরের পর বছর জেল খাটতে হচ্ছে। আরও কতকাল খাটতে হয়, কেইবা জানে? একেই কি বলে স্বাধীনতা? ভয় আমি পাই না, আর মনও শক্ত হয়েছে।
১৯৫২ সালে ঢাকায়
গুলি হওয়ার পরে গ্রামে গ্রামে জনসাধারণ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, যারা শাসন করছে তারা জনগণের আপনজন নয়। খবর
নিয়ে জানতে পারলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি
গুলি হওয়ার খবর বাতাসের সাথে সাথে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে এবং ছোট ছোট হাটবাজারে
পর্যন্ত হরতাল হয়েছে। মানুষ বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, বিশেষ একটা গোষ্ঠী (দল) বাঙালিদের মুখের ভাষা কেড়ে
নিতে চায়।
ভরসা হলো, আর দমাতে পারবে না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা
না করে উপায় নাই। এই আন্দোলনে দেশের লোক সাড়া দিয়েছে ও এগিয়ে এসেছে। কোনো কোনো মাওলানা
সাহেবরা ফতোয়া দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। তাঁরাও ভয় পেয়ে গেছেন। এখন আর প্রকাশ্যে
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না।
জনমত সৃষ্টি
হয়েছে, জনমতের বিরুদ্ধে
যেতে শোষকরাও ভয় পায়। শাসকরা যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন
দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়।
[সংক্ষেপিত]
শব্দার্থ ও টীকা
অনশন ধর্মঘট
- কোনো ন্যায্য দাবি পূরণের লক্ষ্যে একটানা আহার বর্জনের সংকল্প।
সুপারিনটেনডেন্ট
- তত্ত্বাবধায়ক (ংঁঢ়বৎরহঃবহফবহঃ)।
মহিউদ্দিন -
মহিউদ্দিন আহমদ (১৯২৫-১৯৯৭)। রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশের
অভ্যুদয়ের পূর্বে
ও পরে প্রায় সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত
ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাজনৈতিক
কারণে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে দীর্ঘকাল কারাভোগ
করেন
তিনি। ১৯৭৯-১৯৮১
কালপর্বে তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা ছিলেন।
বেলুচি - পাকিস্তানের
বেলুচিস্তান প্রদেশের লোক।
‘ইয়ে কেয়া বাত... মে’ - এ কেমন কথা, আপনি জেলখানায়।
ভিক্টোরিয়া পার্ক
- ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার নামে ঢাকার সদরঘাট এলাকায় প্রতিষ্ঠিত উদ্যান। বর্তমান
নাম বাহাদুর শাহ্ পার্ক।
প্লুরিসিস -
বক্ষব্যাধি।
রেণু - বঙ্গবন্ধুর
সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুনেড়বসা মুজিব। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর
রাজনৈতিক জীবন
ও দুঃসময়ের অবিচল সাথি।
নূরুল আমিন
- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রজনতার ওপর গুলিবর্ষণের জন্য দায়ী তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নূরুল
আমিন পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।
আমলাতন্ত্র
- রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সরকারি কর্মচারীদের কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থা।
আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ
- গণআজাদী লীগ নেতা। ভাষা-আন্দোলনে সμিয় অবদান রেখেছেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব
পালন করেন।
খয়রাত হোসেন
- রাজনীতিবিদ। ১৯৩৮-১৯৪৭ পর্যন্ত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের
কাউন্সিলর। পাকিস্তান
প্রতিষ্ঠার পর নাজিমুদ্দীন সরকারের গণবিরোধী নীতির প্রতিবাদে ১৯৪৮-এ মুসলিম লীগের সঙ্গে
সম্পর্ক ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
খান সাহেব ওসমান
আলী - নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের তৎকালীন বিশিষ্ট নেতা। তিনি আইন সভার সদস্য (এমএলএ)
ছিলেন।
খোন্দকার মোশতাক
আহমেদ - বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংগঠক। ১৯৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে মর্মান্তিক
হত্যায় ষড়যন্ত্র, গোপন সমর্থন
ও সহায়তার জন্য নিন্দিত।
ছোট ভাই - বঙ্গবন্ধুর
কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ নাসের।
হাচিনা, হাচু - বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা।
কামাল - বঙ্গবন্ধুর
জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল।
রেডিওগ্রাম
- বেতারবার্তা (ৎধফরড়মৎধস)।
প্রকোষ্ঠ - ঘর
বা কুঠরি।
পাঠ-পরিচিতি
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের “বায়ান্নর দিনগুলো” তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (২০১২) গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সহধর্মিণীর অনুরোধে বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজবন্দি থাকা অবস্থায়
এই আত্মজীবনী লেখা আরম্ভ করেন।
কিন্তু ১৯৬৮
সালের ১৭ই জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় ঢাকা সেনানিবাসে আটক থাকায়
জীবনী লেখা বন্ধ হয়ে যায়। জীবনীটিতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলি স্থান পেয়েছে। যৌবনের
অধিকাংশ সময় কারা প্রকোষ্ঠের নির্জনে কাটলেও জনগণ-অন্তপ্রাণ এ মানুষটি ছিলেন আপসহীন, নির্ভীক।
জীবনের বিচিত্র
অভিজ্ঞতা, গভীর উপলব্ধি
ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ তিনি এ গ্রন্থে সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন।
“বায়ান্নর দিনগুলো” রচনায় ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন ও জেল
থেকে মুক্তিলাভের স্মৃতি বিবৃত হয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপশাসন ও বিনাবিচারে
বৎসরের পর বৎসর রাজবন্দিদের কারাগারে আটক রাখার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালে লেখক অনশন ধর্মঘট
করেন। স্মৃতিচারণে ব্যক্ত হয়েছে অনশনকালে জেল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ও আচরণ, নেতাকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ ও তাদের কাছে
বার্তা পৌঁছানোর নানা কৌশল ইত্যাদি। স্মৃতিচারণে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে ঢাকায় একুশে
ফেব্রুয়ারি তারিখে ছাত্রজনতার মিছিলে গুলির খবর। সেই সঙ্গে অনশনরত অবস্থায় মৃত্যু অত্যাসনড়ব
জেনে পিতামাতা-স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভাবনা এবং অবশেষে মুক্তি পেয়ে স্বজনদের কাছে ফিরে
আসার স্মৃতির হৃদয়স্পর্শী বিবরণও পরিস্ফুট হয়েছে সংকলিত অংশে।
বহুনির্বাচনি
প্রশড়ব
১. ভাষাসৈনিকদের
শহিদ হওয়ার খবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে পেয়েছিলেন?
ক. সিপাহিদের
মাধ্যমে খ. প্রহরীদের সহায়তায়
গ. রেডিও শুনে
ঘ. বন্দিদের কাছ থেকে
২. ‘আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল’- নূরুল আমিনের কোন বৈশিষ্ট্যের
কারণে বঙ্গবন্ধু এরূপ মন্তব্য করেছেন?
ক. একগুঁয়েমি
খ. নির্বুদ্ধিতা
গ. বিচারবুদ্ধিহীনতা
ঘ. অদূরদর্শিতা
উৎস পরিচিতি
শেখ মুজিবুর
রহমানকে ‘জাতির পিতা‘ উপাধিতে ভূষিত করা হয় কখন?- ৩ মার্চ ১৯৭১
প্রথম বাঙ্গালি
হিসেবে কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেন?- শেখ মুজিবুর রহমান।
জেলখানায় কতজন
অনশনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল?-
দুইজন।
সুপারিটেনডেন্ট
সাহেবের নাম কী?- আমীর হোসেন।
রাজবন্দীদের
ডেপুটি জেলার কে ছিলেন?- মোখলেসুর রহমান।
‘শেখ মুজিবুর
রহমান অনশন করেছিল কেন?- মুক্তির জন্য।
শেখ মুজিবুর
রহমান যখন জেলে যায় তখন কামালের বয়স কত?- মাত্র কয়েক মাস।
মহিউদ্দিন কত
সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা ছিলেন?- ১৯৭৯-৮১ সাল পর্যন্ত।
পুরিসিস কী?- বক্ষব্যাধি।
নূরুল আমিন কে
ছিলেন?- তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধুকে
খুবই ভালোবাসত এবং শ্রদ্ধা করত কে?- সুবেদার।
বঙ্গবন্ধু কোথায়
পৌঁছে খবর পেলেন জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে?- নারায়ণগঞ্জ ঘাটে।
বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান রাত কয়টায় স্টেশনে পৌঁছেছিলেন?- ১১টা।
“জীবনে আর দেখা
নাও হতে পারে”- কথাটিতে বঙ্গবন্ধুর
কোন দিকটি প্রকাশ পেয়েছে?- মৃত্যুচেতনা।
২১ ফেব্রুয়ারিতে
ফরিদপুরে হরতাল পালিত হয়েছিল কেন?- ভাষা রক্ষার জন্য।
‘বায়ান্নর দিনগুলো’ রচনায় কোন কোন জেলার নাম উল্লেখ আছে?- ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল।
গুরুত্বপূর্ণ
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন সাহেব কিসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন?
উত্তর : জেলের ভেতর অনশন ধর্মঘট করার জন্য
প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
জেলের সুপারিনটেনডেন্টের
নাম কী?
উত্তর : আমীর হোসেন।
মোখলেসুর রহমান
কোন পদে চাকরি করতেন?
উত্তর : ডেপুটি জেলার পদে।
কোন আমলা খুবই
লেখাপড়া করতেন?
উত্তর : ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান।
ঢাকা থেকে শেখ
মুজিব ও মহিউদ্দিনকে কোন জেলে পাঠানো হয়?
উত্তর : ফরিদপুর জেলে।
সুবেদার কোথাকার
ছিল?
উত্তর : সুবেদার ছিলেন একজন বেলুচি ভদ্রলোক।
‘ইয়ে কেয়াবাত
হ্যায়, আপ জেলখানা মে’-এর উত্তরে শেখ মুজিব কী বলেছিলেন?
উত্তর : তিনি বলেছিলেন ‘কিসমত’।
প্রবন্ধে কোন
পার্কের কথা উল্লেখ আছে?
উত্তর : ভিক্টোরিয়া পার্ক।
বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান কয়টি চিঠি লিখেছিলেন?
উত্তর : চারটি চিঠি লিখেছিলেন।
বাংলা ভাষার
বিরুদ্ধে কারা ফতোয়া দিতেন?
উত্তর : মওলানা সাহেবরা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে
ফতোয়া দিতেন।
জেলের ভিতর দুজন
কী জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন?
উত্তর : অনশন ধর্মঘট পালন করার জন্য।
দুজন আলোচনা
করে কী ঠিক করেছিলেন?
উত্তর : যাই হোক না কেন, তারা অনশন ভাঙবেন না।
মোখলেসুর রহমান
সাহেব কোন দায়িত্বে ছিলেন?
উত্তর : রাজবন্দিদের ডেপুটি জেলার।
সরকার বছরের
পর বছর রাজবন্দিদের কীভাবে আটক রাখছে?
উত্তর : বিনা বিচারে আটক রাখছে।
মোখলেসুর রহমান
সাহেব কেমন লোক ছিলেন?
উত্তর : খুবই অমায়িক, ভদ্র ও শিক্ষিত লোক ছিলেন।
‘বায়ান্নর দিনগুলো’ রচনায় উল্লেখকৃত কে খুব লেখাপড়া করতেন?
উত্তর : মোখলেসুর রহমান সাহেব।
কত তারিখ সকালবেলা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল গেটে নিয়ে যাওয়া হলো?
উত্তর : ১৫ ফেব্র“য়ারি সকালবেলা।
বঙ্গবন্ধুর মালপত্র, কাপড়-চোপড় ও বিছানা নিয়ে কে হাজির হয়েছিল?
উত্তর : জমাদার সাহেব।
কী চাপা থাকে
না?
উত্তর : খবর চাপা থাকে না।
ঢাকা জেল থেকে
বঙ্গবন্ধুকে কোন জেলে পাঠানো হয়েছিল?
উত্তর : ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়েছিল।
দিনের বেলায়
কয়টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে জাহাজ ছাড়ে?
উত্তর : বেলা এগারোটায়।
কে রওনা দিতে
দেরি করছিলেন?
উত্তর : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দেরি করতে করতে
বঙ্গবন্ধু কয়টা বাজিয়ে দিলেন?
উত্তর : দশটা বাজিয়ে দিলেন।
আর্মড পুলিশের
সুবেদার পাকিস্তান হওয়ার সময় কোথায় ছিলেন?
উত্তর : গোপালগঞ্জে ছিলেন।
কে বঙ্গবন্ধুকে
খুবই ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন?
উত্তর : আর্মড পুলিশের সুবেদার সাহেব।
আর্মড পুলিশের
সুবেদার সাহেব বঙ্গবন্ধুকে কার বিপক্ষে কাজ করতে দেখেছেন?
উত্তর : পাকিস্তানের বিপক্ষে।
বঙ্গবন্ধুদের
নারায়ণগঞ্জের কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো?
উত্তর : নারায়ণগঞ্জের থানায়।
নারায়ণগঞ্জে
বঙ্গবন্ধু কাকে খবর দিতে বললেন?
উত্তর : শামসুজ্জোহা সাহেবকে খবর দিতে
বললেন।
‘বায়ান্নর দিনগুলো’ রচনায় উল্লেখকৃত কার বাড়ি সকলেই চেনে?
উত্তর : খান সাহেব ওসমান আলী সাহেবের বাড়ি।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ
রোডের উপরে নতুন কী হয়েছে?
উত্তর : একটা হোটেল হয়েছে।
কতজন কর্মী নিয়ে
জোহা সাহেব বসেছিলেন?
উত্তর : আট-দশজন কর্মী নিয়ে।
কাদের ত্যাগ
ও তিতিক্ষার কথা কোনো রাজনৈতিক কর্মী ভুলতে পারে না?
উত্তর : নারায়ণগঞ্জের কর্মীদের।
কোন তারিখে নারায়ণগঞ্জে
পূর্ণ হরতাল হয়?
উত্তর : ২১ শে ফেব্র“য়ারি।
কাকে বিশ্বাসের
ব্যাপারে নেতারা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করলেন?
উত্তর : মহিউদ্দিন সাহেবকে।
মানুষকে কী দিয়ে
জয় করা যায়?
উত্তর : ব্যবহার, ভালোবাসা ও প্রীতি দিয়ে।
মানুষকে কী দিয়ে
জয় করা যায় না?
উত্তর : অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে।
নারায়ণগঞ্জের
সহকর্মীরা কতক্ষণ অপেক্ষা করল?
উত্তর : জাহাজ না ছাড়া পর্যন্ত।
নারায়ণগঞ্জ থেকে
ছেড়ে এসে জাহাজ কোন ঘাটে ভিড়ল?
উত্তর : গোয়ালন্দ ঘাটে ভিড়ল।
বঙ্গবন্ধু ও
তাঁর সহযাত্রীরা কখন ফরিদপুর পৌঁছলেন?
উত্তর : রাত চারটায় ফরিদপুর পৌঁছলেন।
বঙ্গবন্ধু কাকে
তাঁর নাম বললেন?
উত্তর : চায়ের দোকানের মালিককে।
ফরিদপুরের আওয়ামী
লীগের কর্মীর নাম কী ছিল?
উত্তর : মহিউদ্দিন।
১৯৪৬ সালের ইলেকশনে
বঙ্গবন্ধু ফরিদপুরে কী ছিলেন?
উত্তর : ওয়ার্কার ইনচার্জ ছিলেন।
ফরিদপুরে আওয়ামী
লীগ কর্মী মহির সাথে আলাপ করতে কে নিষেধ করেছিল?
উত্তর : আইবি’র লোক নিষেধ করেছিল।
বঙ্গবন্ধু ও
তাঁর সহবন্দি তাড়াতাড়ি ওষুধ খেলেন কেন?
উত্তর : পেট পরিষ্কার করার জন্য।
অনশন শুরু করার
কতদিন পর বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহবন্দিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো?
উত্তর : দু’দিন পর।
মহিউদ্দিন সাহেব
যে-রোগে ভুগছিলেন সেটা কী?
উত্তর : প্লুরিসিস।
কত দিন পরে নাক
দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল?
উত্তর : চারদিন পরে।
বঙ্গবন্ধুর নাকে
কী ছিল?
উত্তর : একটা ব্যারাম ছিল।
অনশন শুরু করার
কত দিন পরে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহবন্দি বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন?
উত্তর : পাঁচ-ছয় দিন পরে।
২১শে ফেব্রুয়ারি
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহবন্দি কীভাবে দিন কাটালেন?
উত্তর : উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে।
ছাত্রছাত্রীরা
শোভাযাত্রা করে জেল গেটে এসে কী দিচ্ছিল?
উত্তর : বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল।
১৪৪ ধারা দিলেই
কী হয়?
উত্তর : গোলমাল হয়।
ছাত্রছাত্রী
এক জায়গায় হয়ে কী করে?
উত্তর : স্লোগান দেয়।
মাতৃভাষা আন্দোলনে
কোন জাতি রক্ত দিয়েছে?
উত্তর : বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে।
২১শে ফেব্রুয়ারি
কোথায় গুলি হয়েছিল?
উত্তর : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের
এরিয়ার ভিতরে।
মানুষের পতন
যখন আসে তখন কী হয়?
উত্তর : পদে পদে ভুল হতে থাকে।
উর্দুকে একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলে কার মতো নেতাও বাধা না পেয়ে ফিরে যেতে পারেননি?
উত্তর : কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর
মতো নেতা।
কার জনসমর্থন
কোনোদিন বাংলাদেশে ছিল না?
উত্তর : খাজা নাজিমউদ্দিনের।
কার বাড়ির ভিতরে
ঢুকে ভীষণ মারপিট করা হয়েছে?
উত্তর : ওসমান আলী সাহেবের।
কোথায় ত্রাসের
রাজত্ব সৃষ্টি হয়েছে?
উত্তর : সমস্ত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে।
বঙ্গবন্ধু ও
তাঁর সহবন্দিকে সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে কতবার দেখতে আসতেন?
উত্তর : পাঁচ-সাতবার দেখতে আসতেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর
লেখা চিঠি চারখানা ফরিদপুরে কার কাছে পৌঁছে দিতে বলেছিলেন?
উত্তর : এক আত্মীয়ের কাছে।
বঙ্গবন্ধুর চোখের
সামনে কাদের চেহারা ভাসছিল?
উত্তর : তাঁর বাবা-মা ও ভাই-বোনদের চেহারা
ভাসছিল।
কার দুনিয়ায়
কেউ নেই?
উত্তর : বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী রেণুর।
কার ফরিদপুরে
কেউ নেই?
উত্তর : বঙ্গবন্ধুর সহবন্দি মহিউদ্দিন
সাহেবের।
মহিউদ্দিন সাহেবের
বাড়ি কোথায়?
উত্তর : বরিশালে।
কী মারফত বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির অর্ডার এসেছিল?
উত্তর : রেডিওগ্রাম মারফত।
জেলে কে বঙ্গবন্ধুর
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন?
উত্তর : মহিউদ্দিন সাহেব।
বঙ্গবন্ধুকে
কে ডাবের পানি খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করান?
উত্তর : বঙ্গবন্ধুর সহবন্দি মহিউদ্দিন
সাহেব।
কে জেলে আসার
পূর্বদিন পর্যন্ত মুসলিম লীগের বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন?
উত্তর : বঙ্গবন্ধুর সহবন্দি মহিউদ্দিন
সাহেব।
রাজনীতিতে কী
দেখা গেছে?
উত্তর : রাজনীতিতে দেখা গেছে একই দলের
লোকের মধ্যে মতবিরোধ হলে দুশমনি বেশি হয়।
‘বায়ান্নর দিনগুলো’ রচনা অনুসারে কার সহ্যশক্তি খুব বেশি?
উত্তর : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
পিতার।
বঙ্গবন্ধুকে
কীভাবে ফরিদপুর জেল গেটে নিয়ে যাওয়া হলো?
উত্তর : স্ট্রেচারে করে।
জেল থেকে মুক্তি
পেয়ে বঙ্গবন্ধু কার বাড়িতে উঠলেন?
উত্তর : আলাউদ্দিন খান সাহেবের বাড়িতে।
বঙ্গবন্ধুকে
দেখতে কে রাস্তায় চলে এসেছিলেন?
উত্তর : বঙ্গবন্ধুর এক ফুফু।
বঙ্গবন্ধুর ফুফুবাড়ি
কোন গ্রামে?
উত্তর : নূরপুর গ্রামে।
বঙ্গবন্ধুর বড়
বোনের বাড়ি কোথায়?
উত্তর : মাদারীপুরের দত্তপাড়ায়।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির
খবর পেয়ে কোন ঘাটে কর্মীরা বসেছিল?
উত্তর : সিন্ধিয়াঘাটে।
বঙ্গবন্ধুর ভাই
খবর পেয়ে কোত্থেকে রওনা হলেন?
উত্তর : খুলনা থেকে।
বঙ্গবন্ধু মুক্তি
পাওয়ার কত দিন পর বাড়ি পৌঁছেছিলেন?
উত্তর : পাঁচদিন পর।
বঙ্গবন্ধুর গলা
ধরে তার জ্যেষ্ঠ কন্যা হাসু বা হাসিনা প্রথমেই কী বলল?
উত্তর : “আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।”
বঙ্গবন্ধুর পরিবার
২১শে ফেব্র“য়ারিতে কোথায়
ছিল?
উত্তর : ঢাকায়।
কে বঙ্গবন্ধুকে
দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন?
উত্তর : বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী।
বঙ্গবন্ধুকে
দেখতে সহকর্মীরা কোন কোন জায়গা থেকে এসেছিল?
উত্তর : গোপালগঞ্জ, খুলনা ও বরিশাল থেকে।
কে মাঝে মাঝে
খেলা ফেলে এসে বঙ্গবন্ধুকে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে?
উত্তর : বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা হাসু
বা হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু যখন
জেলে যান তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কামালের বয়স কত ছিল?
উত্তর : মাত্র কয়েক মাস।
কে বঙ্গবন্ধুর
গলা ধরে পড়ে রইল?
উত্তর : বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র কামাল।
বঙ্গবন্ধুর মতে
কয়শ’ বছর পরে আমরা স্বাধীন
হয়েছিলাম?
উত্তর : দুইশ’ বছর পরে।
কবে থেকে গ্রামের
লোকজন বুঝতে আরম্ভ করেছে যে,
যারা শাসন করছে তারা জনগণের আপনজন নয়?
উত্তর : ১৯৫২ সাল থেকে।
রেইকোট [আখতারুজ্জামান ইলিয়াস]
মহাজাগতিক কিউরেটর [মুহম্মদ জাফর ইকবাল]
নেকলেস [মূল লেখক গী দ্য মোপাসাঁ]
লেখক-পরিচিতি
গী দ্য মোপাসাঁ ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের
৫ই আগস্ট ফ্রান্সের নর্মান্ডি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম Henri-Renri-Albert-Guy de Maupassant । তাঁর পিতার নাম গুস্তাভ
দ্য মোপাসাঁ ও মায়ের নাম লরা লি পয়টিভিন (Laure Le Poittevin)। ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে মোপাসাঁ
একটি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে
বিখ্যাত ঔপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লবেয়ার-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পারিবারিক বন্ধু গুস্তাভ
ফ্লবেয়ার মোপাসাঁর সাহিত্য-জীবনে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই মহান লেখকের নির্দেশনা
ও সহযোগিতায় তিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন। ফ্লবেয়ারের বাসায় মোপাসাঁর
পরিচয় ঘটে এমিল জোলা ও ইভান তুর্গনেভসহ অনেক বিশ্ববিখ্যাত লেখকের সঙ্গে। কাব্যচর্চা
দিয়ে তাঁর সাহিত্য-জীবন শুরু হলেও মূলত গল্পকার হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন
করেন। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আদর্শগত কোনো বিশ্বাসে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত না হয়ে
তিনি তাঁর সাহিত্য-চর্চার জগৎ তৈরি করেন। তাঁর বস্তুনিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতার তুলনা বিশ্বসাহিত্যের
ইতিহাসে খুব বেশি লক্ষ করা যায় না। অসাধারণ সংযম ও বিস্ময়কর জীবনবোধ তাঁর রচনাকে তাৎপর্যপূর্ণ
করে তুলেছে।
গী দ্য মোপাসাঁ ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের
৬ই জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
অনুবাদক-পরিচিতি
পূর্ণেন্দু দস্তিদার চট্টগ্রামের
পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০এ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন
একাধারে লেখক ও রাজনীতিবিদ। তাঁর পিতা চন্দ্রকুমার দস্তিদার ও মাতা কুমুদিনী দস্তিদার।
তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অংশ নেওয়ায় কারাবরণ
করেন। পেশাগত জীবনে
তিনি ছিলেন আইনজীবী; সমাজভাবুক লেখক হিসেবেও খ্যাতি ছিল তাঁর। প্রকাশিত গ্রন্থের
মধ্যে রয়েছে : ‘কবিয়াল রমেশ শীল’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’। এছাড়াও তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের
মধ্যে
রয়েছে ‘শেখভের গল্প’ ও ‘মোপাসাঁর গল্প’। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের
৯ই মে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে যাওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন।
সে ছিল চমৎকার এক সুন্দরী
তরুণী। নিয়তির ভুলেই যেন এক কেরানির পরিবারে তার জন্ম হয়েছে। তার ছিল না কোনো আনন্দ, কোনো আশা। পরিচিত হবার, প্রশংসা পাওয়ার, প্রেমলাভ করার এবং কোনো ধনী
অথবা বিশিষ্ট লোকের সঙ্গে বিবাহিত হওয়ার কোনো উপায় তার ছিল না। তাই শিক্ষা পরিষদ আপিসের
সামান্য এক কেরানির সঙ্গে বিবাহ সে স্বীকার করে নিয়েছিল।
নিজেকে সজ্জিত করার অক্ষমতার
জন্য সে সাধারণভাবেই থাকত। কিন্তু তার শ্রেণির অন্যতম হিসেবে সে ছিল অসুখী। তাদের কোনো
জাতিবর্ণ নেই। কারণ জন্মের পরে পরিবার থেকেই তারা শ্রী, সৌন্দর্য ও মাধুর্য সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। সহজাত চাতুর্য, প্রকৃতিগত সুরুচি আর বুদ্ধির নমনীয়তাই হলো তাদের আভিজাত্য, যার ফলে অনেক সাধারণ পরিবারের মেয়েকেও বিশিষ্ট মহিলার সমকক্ষ
করে তোলে। সর্বদা তার মনে দুঃখ। তার ধারণা,
যত সব সুরুচিপূর্ণ
ও বিলাসিতার বস্তু আছে, সেগুলির জন্যই তার জন্ম হয়েছে।
তার বাসকক্ষের দারিদ্র্য, হতশ্রী দেওয়াল, জীর্ণ চেয়ার এবং বিবর্ণ জিনিসপত্রের জন্য সে ব্যথিত
হতো। তার মতো অবস্থার অন্য
কোনো মেয়ে এসব জিনিস যদিও লক্ষ করত না, সে এতে দুঃখিত ও μক্রদ্ধ হতো। যে খর্বকায় ব্রেটন এই সাধারণ ঘরটি তৈরি করেছিল তাকে
দেখলেই তার মনে বেদনাভরা দুঃখ আর বেপরোয়া সব স্বপ্ন জেগে উঠত। সে ভাবত তার থাকবে প্রাচ্য-চিত্র-শোভিত, উচ্চ ব্রোঞ্জ-এর আলোকম-িত
পার্শ্বকক্ষ। আর থাকবে দুজন
বেশ মোটাসোটা গৃহ-ভৃত্য। তারা খাটো পায়জামা পরে যেই বড় আরামকেদারা
দুটি গরম করার যন্ত্র থেকে
বিক্ষিপ্ত ভারি হাওয়ায় নিদ্রালু হয়ে উঠেছে,
তাতে শুয়ে ঘুমিয়ে
থাকবে। সে কামনা করে একটি বৈঠকখানা, পুরানো রেশমি পর্দা সেখানে
ঝুলবে। থাকবে তাতে বিভিন্ন চমৎকার আসবাব,
যার ওপর শোভা
পাবে অমূল্য সব প্রাচীন কৌতূহল-উদ্দীপক সামগ্রী। যেসব পরিচিত ও আকাক্সিক্ষত পুরুষ সব
মেয়েদের কাম্য, সেসব অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সঙ্গে বিকাল পাঁচটায় গল্পগুজব করবার
জন্য ছোট সুরভিত একটি কক্ষ সেখানে থাকবে।
তিনদিন ধরে ব্যবহৃত একখানা
টেবিলক্ল ঢাকা গোল একটি টেবিলে তার স্বামীর বিপরীত দিকে সে যখন সান্ধ্যভোজে বসে এবং
খুশির আমেজে তার স্বামী বড় সুরুয়ার পাত্রটির ঢাকনা তুলতে তুলতে বলে : ‘ও! কি ভালো মানুষ! এর চেয়ে ভালো কিছু আমি চাই না-’ তখন তার মনে পড়বে আড়ম্বরপূর্ণ সান্ধ্যভোজের কথা,
উজ্জ্বল রৌপ্যপাত্রাদি, মায়াময় বনভূমির মধ্যে প্রাচীন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিরল পাখির
চিত্রশোভিত কারুকার্যপূর্ণ পর্দা দিয়ে ঢাকা দেওয়াল-এর কামনা। সে ভাবে, অপরূপ পাত্রে পরিবেশিত হবে অপূর্ব খাদ্য আর গোলাপি রং-এর রোহিত
মাছের টুকরা অথবা মুরগির পাখনা খেতে খেতে মুখে সিংহ-মানবীর হাসি নিয়ে কান পেতে শুনবে
চুপি-চুপি-বলা প্রণয়লীলার কাহিনি।
তার কাছে ফ্রক বা জড়োয়া গহনা
নেই-নেই বলতে কিছু নেই। অথচ ঐ সব বস্তুই তার প্রিয়। তার ধারণা ঐসবের জন্যই তার সৃষ্টি।
সুখী করার, কাম্য হওয়ার, চালাক ও প্রণয়যাচিকা হবার কতই না তার ইচ্ছা।
তার ‘কনভেন্ট’-এর সহপাঠিনী এক ধনী বান্ধবী
ছিল। তার সঙ্গে দেখা করতে তার ভালো লাগত না। কারণ দেখা করে ফিরে এসে তার খুব কষ্ট লাগত।
বিরক্তি, দুঃখ, হতাশা ও নৈরাশ্যে সমস্ত দিন ধরে সে কাঁদত।
এক সন্ধ্যায় হাতে একটি বড়
খাম নিয়ে বেশ উল্লসিত হয়ে তার স্বামী ঘরে ফিরল। সে বলল, ‘এই যে, তোমার জন্য এক জিনিস এনেছি।’
মেয়েটি তাড়াতাড়ি খামটি ছিঁড়ে
তার ভিতর থেকে একখানা ছাপানো কার্ড বের করল। তাতে নিচের কথাগুলি মুদ্রিত ছিল :
‘জনশিক্ষা মন্ত্রী ও মাদাম জর্জ রেমপন্নু আগামী ১৮ই জানুয়ারি
সন্ধ্যায় তাঁহাদের নিজ বাসগৃহে মসিঁয়ে ও মাদাম লোইসেলের উপস্থিতি কামনা করেন।’
তার স্বামী যেমন আশা করেছিল
তেমনভাবে খুশি হওয়ার পরিবর্তে মেয়েটি বিদ্বেষের ভাব নিয়ে আমন্ত্রণ-লিপিখানা টেবিলের
উপর নিক্ষেপ করে, বিড় বিড় করে বলে : ‘ওখানা নিয়ে তুমি আমায় কী করতে বল?’
‘কিন্তু লক্ষ্মীটি,
আমি ভেবেছিলাম, এতে তুমি খুশি হবে। তুমি বাইরে কখনও যাও না, তাই এই এক সুযোগ, চমৎকার এক সুযোগ!
এটা জোগাড় করতে আমাকে অনেক
কষ্ট করতে হয়েছে। সবাই একখানা চায়, কিন্তু খুব বেছে বেছে দেওয়া
হচ্ছে। কর্মচারীদের বেশি দেওয়া হয়নি। সেখানে তুমি গোটা সরকারি মহলকে দেখতে পাবে।’
বিরক্তির দৃষ্টিতে তার দিকে
তাকিয়ে মেয়েটি অধীরভাবে বলে উঠল :
‘ঐ ঘটনার মতো একটি ব্যাপার কী পরে আমি যাব বলে তুমি মনে কর?’
সে ঐ সম্পর্কে কিছু ভাবেনি।
তাই সে বিব্রতভাবে বলে :
‘কেন আমরা থিয়েটারে যাবার সময় তুমি যেই পোশাকটা পর সেটা পরবে।
ওটা আমার কাছে খুব সুন্দর লাগে-’ তার স্ত্রীকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
কাঁদতে দেখে সে আতঙ্কে নির্বাক ও হতবুদ্ধি হয়ে গেল। তার চোখের পাশ থেকে বড় বড় দুফোঁটা অশ্রু তার
গালের উপর গড়িয়ে পড়ল। সে থতমতভাবে বলল : ‘কী হলো? কী হলো তোমার?’
প্রবল চেষ্টায় মেয়েটি নিজের
বিরক্তি দমন করে, তার সিক্ত গ- মুছে ফেলে শান্ত কণ্ঠে
জবাব দেয় : ‘কিছুই না। শুধু আমার কোনো পোশাক নেই
বলে আমি ঐ ব্যাপারে যেতে পারব না। তোমার যে কোন সহকর্মীর স্ত্রীর পোশাক আমার চেয়ে যদি
ভালো থাকে, কার্ডখানা নিয়ে তাকে দাও।’
সে মনে মনে দুঃখ পায়। তারপর
সে জবাব দেয় : ‘মাতিলদা, বেশ তো চল আলাপ করি আমরা। এমন কোনো পোশাক, অন্য কোনো উপলক্ষেও যা দিয়ে কাজ চলবে অথচ বেশ সাদাসিধা, তার দাম কত আর হবে?’
কয়েক সেকেন্ড মেয়েটি চিন্তা
করে দেখে এমন একটি সংখ্যার বিষয় স্থির করল যা চেয়ে বসলে হিসাবি কেরানির কাছ থেকে সঙ্গে
সঙ্গে এক আতঙ্কিত প্রত্যাখ্যান যেন না আসে। শেষপর্যন্ত ইতস্তত করে মেয়েটি বলল :
‘আমি ঠিক বলতে পারছি না, তবে আমার মনে হয় চারশ ফ্রাঁ হলে তা কেনা যাবে।’
শুনে তার মুখ ম্লান হয়ে গেল।
কারণ, তার যেসব বন্ধু গত রবিবারে নানতিয়ারের
সমভূমিতে ভরতপাখি শিকারে গিয়েছিল, আগামী গ্রীষ্মে তাদের সঙ্গে
যোগ দেওয়ার ইচ্ছায় একটি বন্দুক কিনবার জন্য ঠিক ততটা অর্থই সে সঞ্চয় করেছিল। তা সত্ত্বেও
জবাব দিল : ‘বেশ ত। আমি তোমায় চারশত ফ্রাঁ দেব।
কিন্তু বেশ সুন্দর একটি পোশাক কিনে নিও।’
‘বল’-নাচের দিন যতই এগিয়ে আসতে
থাকে ততই মাদাম লোইসেলকে বিচলিত ও উদ্বিগ্ন মনে হয়। অবশ্য তার পোশাক প্রায় তৈরি হয়ে
এসেছে। একদিন সন্ধ্যায় তার স্বামী তাকে বলল : ‘তোমার
হয়েছে কী? গত দুই-তিন দিন ধরে তোমার কাজকর্ম
কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে।’
শুনে মেয়েটি জবাব দেয়, ‘আমার কোনো মণিমুক্তা,
একটি দামি পাথর
কিছুই নেই যা দিয়ে আমি নিজেকে সাজাতে পারি। আমায় দেখলে কেমন গরিব গরিব মনে হবে। তাই
এই অনুষ্ঠানে আমার না যাওয়াই ভালো হবে।’
স্বামী বলল, ‘কিছু সত্যকার ফুল দিয়ে তুমি সাজতে পার। এই ঋতুতে তাতে বেশ সুরুচিপূর্ণ
দেখায়। দশ ফ্রাঁ দিলে তুমি দুটি কি তিনটি অত্যন্ত চমৎকার গোলাপফুল পাবে।’ মেয়েটি ঐ কথায় আশ্বস্ত হলো না। সে জবাবে বলল, ‘না, ধনী মেয়েদের মাঝখানে পোশাকে-পরিচ্ছদে
ঐ রকম খেলো দেখানোর মতো আর বেশি কিছু অপমানজনক নেই।’ তখন তার স্বামী চেঁচিয়ে উঠল : ‘আচ্ছা, কী বোকা দেখত আমরা! যাও, তোমার বান্ধবী মাদার ফোরসটিয়ারের সঙ্গে দেখা করে তাকে বল তার জড়োয়া গহনা যেন তোমায়
ধার দেয়। এটুকু আদায় করার তো তার সঙ্গে
তোমার পরিচয় যথেষ্ট।’ সে আনন্দধ্বনি করে উঠল। তারপর সে বলল :
‘সত্যিই তো! এটা আমি ভাবিনি।’ পরদিন সে তার বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে তার দুঃখের কাহিনি তাকে বলল। মাদাম ফোরসটিয়ার
তার কাচের দরজা লাগানো গোপনকক্ষে গিয়ে বড় একটি জড়োয়া গহনার বাক্স বের করে এনে তা খুলে
বলল : ‘ভাই, যা ইচ্ছা এখান থেকে নাও।’
সে প্রথমে দেখল কয়েকটি কঙ্কন, তারপর একটি মুক্তার মালা ও মণিমুক্তা-খচিত চমৎকার কারুকার্য-ভরা
একটি সোনার ভিনিশাঁর ‘μক্রশ’। আয়নার সামনে গিয়ে সে জড়োয়া গহনাগুলি পরে পরে দেখে আর ইতস্তত
করে, কিন্তু ওগুলি নেওয়ার সিদ্ধান্তও করতে
ছেড়ে যেতেও পারে না। তারপর সে জিজ্ঞাসা করে : ‘আর
কিছু তোমার নেই?’ ‘কেন? আছে, তোমার যা পছন্দ তুমি তা বেছে
নাও।’
হঠাৎ সে কালো স্যাটিনের একটি
বাক্সে দেখল অপরূপ একখানা হীরার হার। অদম্য কামনায় তার বুক দুর দুর করে। সেটা তুলে
নিতে গিয়ে তার হাত কাঁপে। সে তার পোশাকের উপর দিয়ে সেটা গলায় তুলে নেয় এবং সেগুলো দেখে
আনন্দে বিহ্বল হয়ে যায়। তারপর উদ্বেগভরা,
ইতস্ততভাবে
সে জিজ্ঞাসা করল :
‘তুমি ঐখানা আমায় ধার দেবে? শুধু এটা?’ ‘কেন দেব না? নিশ্চয়ই দেব।’
সে সবেগে তার বান্ধবীর গলা
জড়িয়ে ধরে, পরম আবেগে তাকে বুকে চেপে ধরে। তারপর
তার সম্পদ নিয়ে সে চলে আসে।
‘বল’ নাচের দিন এসে গেল। মাদাম
লোইসেলের জয়জয়কার। সে ছিল সবচেয়ে সুন্দরী,
সুরুচিময়ী, সুদর্শনা, হাস্যময়ী ও আনন্দপূর্ণ। সব
পুরুষ তাকে লক্ষ করছিল, তার নাম জিজ্ঞাসা করে তার
সঙ্গে আলাপের আগ্রহ প্রকাশ করছিল। মন্ত্রিসভার সব সদস্যের তার সঙ্গে ‘ওয়ালটজ’ নৃত্য করতে ইচ্ছা হচ্ছিল।
স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী তার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছিলেন।
আনন্দে মত্ত হয়ে আবেগ ও উৎসাহ
নিয়ে সে নৃত্য করছিল। তার রূপের বিজয়গর্বে,
সাফল্যের গৌরবে
সে আর কিছুই ভাবে না। এক আনন্দের মেঘের ওপর দিয়ে যেন ভেসে আসছিল এই সব আহুতি ও মুগ্ধতা
আর জাগ্রত
সব কামনা। যে কোনো মেয়ের
অন্তরে এই পরিপূর্ণ বিজয় কত মধুর!
ভোর চারটার দিকে সে বাড়ি
ফিরে গেল। অন্য সেই তিনজন ভদ্রলোকের স্ত্রী খুব বেশি ফুর্তিতে মত্ত ছিল, তাদের সঙ্গে তার স্বামী ছোট একটি বিশ্রামকক্ষে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত
আধঘুমে বসেছিল। বাড়ি ফিরবার পথে গায়ে জড়াবার জন্য তারা যে আটপৌরে সাধারণ চাদর নিয়ে
এসেছিল সে তার কাঁধের ওপর সেটি ছড়িয়ে দেয়। ‘বল’ নাচের পোশাকে অপরূপ সৌন্দর্যের সঙ্গে ঐটির দারিদ্র্য সুপরিস্ফুট
হয়ে উঠছিল।
মেয়েটি তা অনুভব করতে পারে
তাই অন্য যেসব ধনী মেয়ে দামি পশমি চাদর দিয়ে গা ঢেকেছিল তাদের চোখে না পড়বার জন্য সে
তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে লাগল। লোইসেল তাকে টেনে ধরে বলল : ‘থামো, তোমার ঠা-া লেগে যাবে ওখানে।
আমি একখানা গাড়ি ডেকে আনি।’
কিন্তু মেয়েটি কোনো কথায়
কান না দিয়ে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। রাস্তায় যখন তারা পৌঁছে গেল, সেখানে কোনো গাড়ি পাওয়া গেল না। তারা গাড়ির খোঁজ করতে করতে
দূরে কোনো একখানাকে দেখে তার গাড়োয়ানকে ডাকতে থাকে।
হতাশ হয়ে কাঁপতে কাঁপতে তারা
সিন নদীর দিকে হাঁটতে থাকে। শেষ পর্যন্ত যে পুরাতন একখানা তারা পায়, তাহলো সেই নিশাচর দুই-যাত্রীর গাড়ি যা প্যারিতে সন্ধ্যার পর
লোকের চোখে পড়ে, তার একখানা, যেইদিনে এইগুলি নিজের দুর্দশা দেখাতে লজ্জা পায়।
ঐ খানি তাদের মার্টার স্ট্রিটে
ঘরের দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেল। তারা ক্লান্তভাবে তাদের কক্ষে গেল। মেয়েটির সব কাজ শেষ।
কিন্তু স্বামীর ব্যাপারে, তার মনে পড়ল যে দশটায় তাকে
আপিসে গিয়ে পৌঁছাতে হবে।
নিজেকে গৌরবম-িত রূপে শেষ
একবার দেখার জন্য সে আয়নার সামনে গিয়ে তার গলার চাদরখানা খোলে।
হঠাৎ সে আর্তনাদ করে উঠল।
তার হারখানা গলায় জড়ানো নেই।
তার স্বামীর পোশাক তখন অর্ধেক
মাত্র খোলা হয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল : ‘কী হয়েছে?’ উত্তেজিতভাবে মেয়েটি তার দিকে ফিরে বলল :
‘আমার-আমার কাছে-মাদাম ফোরস্টিয়ারের হারখানা নেই।’
আতঙ্কিতভাবে সে উঠে দাঁড়াল
: ‘কী বললে! তা কী করে হবে? এটা সম্ভব নয়।’
পোশাকের ও বহির্বাসের ভাঁজের
মধ্যে, পকেটে, সব জায়গায় তারা খোঁজ করে। কিন্তু তা পাওয়া গেল না।
স্বামী জিজ্ঞাসা করল : ‘ঐ বাড়ি থেকে চলে আসবার সময় তা যে তোমার গলায় ছিল, তোমার ঠিক মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, আমরা যখন বিশ্রামকক্ষ দিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম, তখনও তা ছিল আমার খেয়াল আছে।’
‘কিন্তু তুমি যদি ওটা রাস্তায় হারাতে, ওটা পড়বার শব্দ আমাদের শোনা উচিত ছিল। গাড়ির মধ্যেই নিশ্চয়ই
পড়েছে মনে হয়।’
‘হ্যাঁ, সম্ভবত তাই। তুমি গাড়ির নম্বরটি
টুকে নিয়েছিলে?’ ‘না। আর তুমি কি তা লক্ষ করেছিলে?’ ‘না।’ হতাশভাবে তারা একে অপরের
দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত লোইসেল আবার পোশাক পরে নিল।
সে বলল, ‘আমি যাচ্ছি। দেখি যতটা রাস্তা আমরা হেঁটেছিলাম, সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।’ তারপর সে গেল। মেয়েটি তার সান্ধ্য গাউন পরেই রয়ে গেল। বিছানায়
শুতে যাবার শক্তি তার নেই। কোনো উচ্চাশা বা ভাবনা ছাড়াই সে একখানা চেয়ারে গা এলিয়ে
পড়ে রইল।
সকাল সাতটার দিকে তার স্বামী
ফিরে এল। কিছুই সে খুঁজে পায়নি।
সে পুলিসের কাছে ও গাড়ির
আপিসে গিয়েছিল এবং পুরস্কার ঘোষণা করে একটা বিজ্ঞাপনও দিয়ে এসেছে। সে যথাসাধ্য করে
এসেছে বলে তাদের মনে কিছুটা আশা হলো। ঐ ভয়ানক বিপর্যয়ে মেয়েটি সারাদিন এক বিভ্রান্ত
অবস্থায় কাটাল। সন্ধ্যাবেলা যখন লোইসেল ফিরে এল তখন তার মুখে যন্ত্রণার মলিন ছাপ, কিছুই সে খুঁজে পায়নি।
সে বলল, ‘তোমার বান্ধবীকে লিখে দিতে হবে যে হারখানার আংটা তুমি ভেঙে ফেলেছ, তাই তা তুমি মেরামত করতে দিয়েছ। তাতে আমরা ভেবে দেখবার সময় পাব।’ তার নির্দেশমত মেয়েটি লিখে দিল।
এক সপ্তাহ শেষ হওয়ায় তারা
সব আশা ত্যাগ করল। বয়সে পাঁচ বছরের বড় লোইসেল ঘোষণা করল : ‘ঐ জড়োয়া গহনা ফেরত দেবার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।’
পরদিন যেই বাক্সে ওটা ছিল, তার ভিতরে যেই স্বর্ণকারের নাম ছিল, তার কাছে তারা সেটা নিয়ে গেল। সে তার খাতাপত্র ঘেঁটে বলল :
‘মাদাম, ঐ হারখানা আমি বিক্রি করিনি, আমি শুধু বাক্সটা দিয়েছিলাম।’
তারপর তারা সেই হারটির মত
হার খোঁজ করার জন্য, তাদের স্মৃতির উপর নির্ভর
করে এক স্বর্ণকার থেকে অন্য স্বর্ণকারের কাছে যেতে থাকে। দু’জনেরই শরীর বিরক্তি ও উদ্বেগে খারাপ হয়ে গেছে।
প্যালেস রয়েলে তারা এমন এক
হীরার কণ্ঠহার দেখল সেটা ঠিক তাদের হারানো হারের মতো। তার দাম চল্লিশ হাজার ফ্রাঁ।
ছত্রিশ হাজার ফ্রাঁতে তারা তা পেতে পারে।
তিন দিন যেন ওটা বিক্রি না করে সে জন্য তারা স্বর্ণকারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করল। তারা
আরও ব্যবস্থা করল যে, যদি ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হওয়ার
আগে ঐ হারটি খুঁজে পাওয়া যায়, তারা এটা ফেরত দিলে চৌত্রিশ
হাজার ফ্রাঁ ফেরত নিতে পারবে।
লোইসেলের কাছে তার বাবার
মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত আঠারো হাজার ফ্রাঁ ছিল। বাকিটা সে ধার করল। মাদাম লোইসেল যখন জড়োয়া
গহনা মাদাম ফোরস্টিয়ারকে ফেরত দিতে গেল তখন শেষোক্ত মেয়েটি
নির্জীবকণ্ঠে বলল : ‘ওটা আরও আগে তোমায় ফেরত দেওয়া উচিত ছিল; কারণ, তা আমারও দরকার হতে পারত।’
তার বান্ধবী সেই ভয় করেছিল, তেমনভাবে সে গহনার বাক্সটি খুলল না। যদি বদলে দেওয়া হয়েছে সে
টেরপেত, সে কী মনে করত? সে কী বলত? সে কি তাকে অপহারক ভাবত?
এবার মাদাম লোইসেল দারিদ্র্যের
জীবনের ভয়াবহতা বুঝতে পারে। সে তার নিজের কাজ সম্পূর্ণ সাহসের সঙ্গেই করে যায়। ঐ দুঃখজনক
দেনা শোধ করা প্রয়োজন। সে তা দেবে। দাসীকে তারা বিদায় করে দিল। তারা তাদের বাসা পরিবর্তন করল। নিচু ছাদের কয়েকটি কামরা তারা
ভাড়া করল।
ঘরকনড়বার কঠিন সব কাজ ও রানড়বাঘরের
বিরক্তিকর কাজকর্ম সে শিখে নিল। তার গোলাপি নখ দিয়ে সে বাসন ধোয়, তৈলাক্ত পাত্র ও ঝোল রাঁধার কড়াই মাজে। ময়লা কাপড়-চোপড়, শেমিজ, বাসন মোছার গামছা সে পরিষ্কার করে দড়িতে শুকাতে দেয়। রোজ সকালে সে আবর্জনা
নিয়ে রাস্তায় ফেলে। সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপে শ্বাস নেবার জন্য থেমে থেমে সে জল তোলে। সাধারণ
পরিবারের মেয়ের মতো পোশাক পরে সে হাতে ঝুড়ি নিয়ে মুদি, কসাই ও ফলের দোকানে যায় এবং
তার দুঃখের পয়সার একটির জন্য পর্যন্ত দর কষাকষি করে।
প্রত্যেক মাসেই সময় চেয়ে
কিছু দলিল বদল করতে হয়, কাউকে কিছু শোধ দিতে হয়।
তার স্বামীও সন্ধ্যাবেলা কাজ করে। সে কয়েকজন ব্যবসায়ীর হিসাবের খাতা ঠিক করে। রাত্রে
এক পাতা পাঁচ ‘সাও’ হিসেবে সে প্রায়ই লেখা নকল করে।
এরকম জীবন দশ বছর ধরে চলল।
দশ বছরের শেষে তারা সব কিছু
মহাজনের সুদসহ প্রাপ্য নিয়ে সব ক্ষতিপূরণ করে ফেলতে পারে। তাছাড়া কিছু তাদের সঞ্চয়ও
হলো।
মাদাম লোইসেলকে দেখলে এখন
বয়স্কা বলে মনে হয়। সে এখন গরিব গৃহস্থঘরের শক্ত, কর্মঠ ও অমার্জিত মেয়ের মতো হয়ে গেছে। তার চুল অবিন্যস্ত, ঘাঘরা একপাশে মোচড়ানো,
হাতগুলো লাল।
সে চড়াগলায় কথা বলে এবং বড় বড় কলসিতে জল এনে মেঝে ধোয়। কিন্তু কখনও, তার স্বামী যখন আপিসে থাকে, জানালার ধারে বসে বিগত দিনের সেই সান্ধ্য অনুষ্ঠান ও সেই ‘বল’ নাচে তাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল
ও এমন অতিরিক্ত প্রশংসা পেয়েছিল, তার কথা সে ভাবে।
যদি সে গলার সেই হারখানা
না হারাত তাহলে কেমন হতো? কে জানে কে বলতে পারে? কী অনন্যসাধারণ এই জীবন আর তার মধ্যে কত বৈচিত্র্য! সামান্য
একটি বস্তুতে কী করে একজন ধ্বংস হয়ে যেতে আবার বাঁচতেও পারে!
এক রবিবারে সারা সপ্তাহের
নানা দুশ্চিন্তা মন থেকে দূর করার জন্য সে যখন চামপস্-এলিসিস-এ ঘুরে বেড়াচ্ছিল,
হঠাৎ একটি শিশু
নিয়ে ভ্রমণরতা একজন মেয়ে তার চোখে পড়ল। সে হলো মাদাম ফোরস্টিয়ার। সে এখনও যুবতী, সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া। দেখে মাদাম লোইসেলের মন খারাপ হয়ে গেল।
সে কি ঐ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবে? হ্যাঁ, অবশ্যই বলবে। তাকে যখন সব শোধ করা হয়েছে তখন সব কিছু খুলে সে
বলবে। কেন বলবে না?
সে মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়ে
বলল : ‘সুপ্রভাত, জেনি।’
তার বন্ধু তাকে চিনতে পারল
না। এক সাধারণ মানুষ তাকে এমন অন্তরঙ্গভাবে সম্বোধন করায় সে অবাক হলো। সে বিব্রতভাবে
বলল :
‘কিন্তু মাদাম-আপনাকে তো চিনলাম না-বোধহয় আপনার ভুল হয়েছে-’
‘না, আমি মাতিলদা লোইসেল।’
তার বান্ধবী বিস্ময়ে চেঁচিয়ে
উঠে বলল : ‘হায়, আমার বেচারী মাতিলদা! এমনভাবে কী করে তুমি বদলে গেলে-’
‘হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর
থেকে আমার দুর্দিন যাচ্ছে-বেশ কিছু দুঃখের দিন গেছে-আর সেটা হয়েছে শুধু তোমার জন্য-’
‘আমার জন্য? তা কী করে হলো?’
‘সেই যে কমিশনারের ‘বল’ নাচের দিন তুমি আমাকে তোমার হীরার হার পরতে দিয়েছিলে, মনে পড়ে?’ ‘হ্যাঁ, বেশ মনে আছে।’
‘কথা হচ্ছে, সেখানা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
‘কী বলছ তুমি? কী করে তা আমায় তুমি ফেরত
দিয়েছিলে?’
‘ঠিক সেখানার মতো একটি তোমাকে আমি ফেরত দিয়েছিলাম। তার দাম দিতে
দশ বছর লেগেছে। তুমি বুঝতেই পার, আমাদের মতো লোক যাদের কিছুই
ছিল না, তাদের পক্ষে তা সহজ ছিল না। কিন্তু
তা শেষ
হয়েছে এবং সেজন্য আমি এখন
ভালোভাবেই নিশ্চিন্ত হয়েছি।’
মাদাম ফোরস্টিয়ার তাকে কথার
মাঝপথে থামিয়ে বলল :
‘তুমি বলছ যে, আমারটা ফিরিয়ে দেবার জন্য
তুমি একখানা হীরার হার কিনেছিলে?’
‘হ্যাঁ। তা তুমি খেয়াল করনি? ঐ দুটি এক রকম ছিল।’
বলে সে গর্বের ভাবে ও সরল
আনন্দে একটু হাসল। দেখে মাদাম ফোরস্টিয়ার-এর মনে খুব লাগল। সে তার দুটি হাত নিজের হাতের
মধ্যে নিয়ে বলল :
‘হায়, আমার বেচারী মাতিলদা! আমারটি
ছিল নকল। তার দাম পাঁচশত ফ্রাঁর বেশি হবে না।’
শব্দার্থ ও টীকা
✏ কনভেন্ট − খ্রিষ্টান নারী মিশনারিদের দ্বারা
পরিচালিত স্কুল। মিশনারিদের আবাস।
✏ মাসিঁয়ে − সৌজন্য প্রদর্শন ও সম্মান জানানোর জন্য
ফ্রান্সে পুরুষদের মসিঁয়ে সম্মোধন করা হয়।
✏ মাদাম − সৌজন্য প্রদর্শন ও সম্মান জানানোর জন্য
ফ্রান্সে মহিলাদের মাদাম সম্মোধন করা হয়।
✏ ফ্রাঁ − ফরাসি মুদ্রার নাম। ২০০২ সাল পর্যন্ত
এই মুদ্রা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের
সদস্য হওয়ায় ফ্রান্স ইউরো ব্যবহার করে।
✏ ‘বল’ নাচ − বিনোদনমূলক সামাজিক নৃত্যানুষ্ঠান।
ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু দেশে এই নৃত্য
প্রচলিত।
✏ μক্রুশ − খ্রিষ্টান
ধর্মীয় প্রতীক।
✏ স্যাটিন − মসৃণ ও চকচকে রেশমি বস্ত্র। !Satin
✏ প্যারী − প্যারিসের ফরাসি নাম।
✏ প্যালেস রয়েল − রাজকীয় প্রাসাদ।
পাঠ-পরিচিতি
বিশ্ববিখ্যাত গল্পকার গী
দ্য মোপাসাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর মধ্যে ‘নেকলেস’ অন্যতম। ফরাসি ভাষায় গল্পটির নাম ‘La Parure’। ১৮৮৪ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ফরাসি পত্রিকা ‘ La
Gaulois’-এ গল্পটি প্রকাশিত হয় এবং সে বছরই ইংরেজিতে অনূদিত হয়। একই সালে প্রকাশিত ‘নেকলেস’ শীর্ষক গল্পগ্রন্থের মধ্যে
গল্পটি স্থান পায়। অপ্রত্যাশিত কিন্তু অত্যন্ত
আকর্ষণীয় সমাপ্তির জন্য গল্পটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন:
১. এক সন্ধ্যায় মাদাম লোইসেলের
স্বামী মঁসিয়ে কী হাতে ঘরে ফিরলেন?
ক. সুন্দর গয়নার বাক্স খ. একটি বড় খাম
গ. উজ্জ্বল রৌপ্য পাত্র ঘ. কারুকার্যপূর্ণ পর্দা
২. মাদাম লোইসেলের সর্বদা
দুঃখ, কারণ, সে−
ক. নেকলেস হারিয়ে ফেলেছে খ. কাক্সিক্ষত জীবন পায়নি
গ. রানড়বাঘরে কাজ করে ঘ. দামি পোশাক পরতে পারেন
গুরুত্বপূর্ণ শব্দার্থ:
পারিভাষিক শব্দ
No comments:
Post a Comment